বাংলাদেশ বিমানের ৮ বৈদেশিক স্টেশন: অপারেশন ম্যানেজার প্রত্যাহার।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সব আন্তর্জাতিক স্টেশনের অপারেশন ম্যানেজারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন থেকে এই পদে থাকা কর্মকর্তাদের কাজ দেখভাল করবেন কান্ট্রি ম্যানেজার। বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মূলত খরচ বাঁচাতে পর্ষদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানা গেছে, এ সিদ্ধান্তের ফলে শিগগিরই বিদেশে অবস্থানরত বিমানের ৮ আন্তর্জাতিক স্টেশনে কর্মরত অপারেশন ম্যানেজারকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হবে। স্টেশনগুলো হল- যুক্তরাজ্য, জেদ্দা, রিয়াদ, আবুধাবি, দুবাই, মালয়েশিয়া, দিল্লি ও কলকাতা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পরিচালনা পর্ষদের এ সিদ্ধান্ত বিমানকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। কারণ অপারেশন ম্যানেজারদের মূল কাজ হচ্ছে ফ্লাইট প্ল্যানিং, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, বিভিন্ন দেশের আকাশের নোটাম চেক ও জিরো ফুয়েলিং ক্যালকুলেশন করা। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশসহ আশপাশের দেশের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে ফ্লাইট পরিচালনা নির্বিঘ্ন করা।
দেশের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের লাইসেন্সধারী কর্মকর্তারাই অপারেশন ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। লাইসেন্স ছাড়া কোনো কর্মকর্তা এ পদে নিয়োগ পাওয়ারও সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে অপারেশন ম্যানেজারের কাজগুলো কান্ট্রি ম্যানেজার বা অন্য কোনো কর্মকর্তাকে দিয়ে করানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
সিভিল এভিয়েশনের ট্রাফিক কন্ট্রোল বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, বৈদেশিক স্টেশন থেকে অপারেশন ম্যানেজারদের প্রত্যাহার করা হলে ফ্লাইট পরিচালনায় বিমানকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে। ছোটখাটো কোনো টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে বিমানকে বড় ধরনের জরিমানাও গুনতে হতে পারে। এমনকি সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বিমানের ফ্লাইট সাসপেন্ডও করে দিতে পারে। তাছাড়া যেহেতু কান্ট্রি ম্যানেজার কিংবা স্টেশন ম্যানেজারের এ সংক্রান্ত কোনো লাইসেন্স নেই সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে এ কাজ করাও কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
এদিকে খরচ বাঁচাতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, এ কাজের জন্য আউটসোর্সিং ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। জিএসএ (জেনারেল সেলস এজেন্ট), সিএসএ (কার্গো সেল্স এজেন্ট), গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের মতো নতুন করে একটি বিদেশি কোম্পানিকে এই কাজ দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে। যা থেকে লুটপাট, দুর্নীতি ও আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংয়ের সুযোগ পাবে বিমানের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট।
একই সঙ্গে যে খরচ বাঁচানোর জন্য অপারেশন ম্যানেজার প্রত্যাহার করা হচ্ছে আউটসোর্সিংয়ে তার চেয়ে বেশি খরচ গুনতে হতে পারে বিমানকে। পাশাপাশি একটি ফ্লাইট যেসব দেশের ওপর দিয়ে যাবে সেসব দেশের আকাশের নোটাম তল্লাশিতে সামান্য ত্রুটি হলে আকাশে ওই ফ্লাইট বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। এমনকি ফ্লাইটে ফ্লাইটে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটতে পারে।
বিমানের একজন অপারেশন ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যে কোনো এয়ারলাইন্সের জন্য অপারেশন ম্যানেজার ও পাইলট বাধ্যতামূলক। সিভিল এভিয়েশন থেকে লাইসেন্স নিয়ে তাদের এ কাজ করতে হয়। একজন পাইলট যেভাবে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স পান একইভাবে দেড় বছরে ৭ ধরনের পরীক্ষা দিয়ে অপারেশন ম্যানেজারকেও লাইসেন্স নিতে হয়। কোনো কর্মকর্তা যদি ৪ বার পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেন তাহলে তাকে আর পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় না।
লাইসেন্স ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট দেশের অফিসগুলোতে ঢুকতে দেয়া হয় না। কিন্তু বিমানের অদক্ষ ম্যানেজমেন্ট অপারেশন ম্যানেজারদের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে না। কিংবা লুটপাট বাণিজ্য ও আউটসোর্সিং বাণিজ্য করার জন্য পর্ষদ সদস্যদের ভুল তথ্য দিয়ে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিমানের লন্ডন অফিসের অপারেশন ম্যানেজারকে ৩৯টি দেশের সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ফ্লাইট অপারেশন অব্যাহত রাখতে হয়। এ কাজ অন্য কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর প্রতিদিনই ওই কর্মকর্তাকে ৩৯টি দেশের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল শাখার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পান থেকে চুন খসলেই বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বিমান। একইভাবে দুবাই অফিসকে ২৫টি, মালয়েশিয়া অফিসকে ২৭টি দেশের সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে প্রতিদিনই যোগাযোগ রক্ষা করতে হচ্ছে। এই কর্মকর্তার মতে- কান্ট্রি ম্যানেজার, স্টেশন ম্যানেজার, অ্যাকাউন্ট ম্যানেজারের চেয়েও এ পদ খুবই গুরত্বপূর্ণ। জানা গেছে, বিমানের তেল খরচ কমাতেও একজন অপারেশন ম্যানেজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যদি কোনো স্টেশনে অপারেশন ম্যানেজার না থাকে তাহলে ওই অফিসে তেল খরচে বড় ধরনের লুটপাট শুরু হয়ে যাবে। কারণ একমাত্র অপারেশন ম্যানেজারই জিরো ফুয়েলিং ক্যালকুলেশন করতে পারে। অন্য কারও এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি সঠিকভাবে জিরো ফুয়েলিং নিরীক্ষা না করা হয় তাহলে তেল খরচ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে পাইলটরা যা বলবেন বিমানকে সেই অনুপাতে তেলের খরচ গুনতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের হিসাব শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, তেল নিয়ে লুটপাট বাণিজ্য করার জন্যই মূলত একটি চক্র কৌশলে সব বৈদেশিক স্টেশন থেকে অপারেশন ম্যানেজারদের প্রত্যাহার করার জন্য পর্ষদ সদস্যদের ভুল তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, বর্তমানে বিমান ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ পদে থাকা একজন কর্মকর্তা এ ক্ষেত্রে বেশি লাভবান হবেন। ধারণা করা হচ্ছে, এ কারণে তার পক্ষের লোকজন যোগসাজশে তেল খরচে অবৈধ সুবিধা নিতেই এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।
বর্তমানে বিমানে ২০ থেকে ৩০ জন অপারেশনাল কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের মধ্যে লাইসেন্সধারী আছেন ১৫ থেকে ২০ জন। তাদের নিয়ে বিমানে আলাদা একটি বিভাগও রয়েছে। সম্প্রতি এ বিভাগের একজন জেনারেল ম্যানেজার অবসরে গেলে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ তাকে তাৎক্ষণিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন।
সব আন্তর্জাতিক স্টেশনের অপারেশন ম্যানেজারকে প্রত্যাহার করা প্রসঙ্গে বিমানের মুখপাত্র ও ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। বিমানের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিষয়টি গত বোর্ড সভার আগের বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। গত পর্ষদে রিভিউয়ের জন্য আবারও ফাইল উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু পর্ষদ রিভিউ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আগের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে।
তিনি বলেন, বিমানের বর্তমানে ১৬টি আন্তর্জাতিক স্টেশন আছে। এর মধ্যে মাত্র ৮টি স্টেশনে অপারেশন ম্যানেজার (ওএম) আছে। যদি ৮টি স্টেশন ওএম ছাড়া চলতে পারে তাহলে বাকিগুলো চলতে পারবে না কেন? তার মতে, অপারেশন ম্যানেজারদের ঢাকায় ফেরত এনে ফরেন ক্যারিয়ার হ্যান্ডেলিংয়ের কাজে লাগানো হবে। বর্তমানে বিমান ৬-৭টি বিদেশি এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং দিয়ে থাকে। এদের মধ্যে ওয়াইড এয়ারক্রাফটের জন্য ২৫০ ডলার ও ছোট এয়ারক্রাফটের হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য ১৫০ ডলার করে আয় হচ্ছে। ওই পরিচালক আরও বলেন, ওএমের কাজে আউটসোর্সিং করার প্রয়োজন হবে না। কান্ট্রি ম্যানেজারদের দিয়ে করানো সম্ভব হবে। এ নিয়ে কোনো দুর্নীতির সুযোগ নেই।