বেবিচকের এওসি বাণিজ্য

Bebicokএভিয়েশন নিউজ: বেবিচকে (বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) চলছে কোটি টাকার এওসি (এয়ার অপারেটর সার্টিফিকেট) বাণিজ্য। বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের নামে এ বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এয়ার অপারেটর সার্টিফিকেট দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন মানা হচ্ছে না। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করতে পারছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আন্তজাতিক আইন অনুযায়ী একটি এয়ারলাইন্সের বিপরীতে বছরে একবার এওসি ইস্যু করার বিধান থাকলেও বেবিচক সেটা মানছে না। কাউকে ৩ মাস কাউকে ৬ মাস করে এওসি দিচ্ছে। এমনকি ৮-১০ দিনের জন্যও এওসি দেয়ার রেকর্ড রয়েছে। এয়ারলাইন্সগুলোর বিপরীতে প্রতিবারই এওসি ইস্যু, নবায়ন নিয়ে কোটি কোটি টাকার ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং’র’ অভিযোগ উঠেছে।

সিভিল এভিয়েশন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই এওসি বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মূলত ২০১০ সালের পর থেকে অযৌক্তিকভাবে বেবিচক প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের এওসি নবায়নের সময়সীমা নির্ধারণে এই নিয়ম তৈরি করেছে। এ অবস্থায় বেসরকারি এয়ারলাইন্সের ব্যবসায় ধস নামার আশংকা দেখা দিয়েছে।

মূলত বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোকে ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে দিতে একটি সিন্ডিকেট কৌশলে এই এওসি বাণিজ্য চালু করেছে। এতে একদিকে প্রতিবারই এওসি নবায়নে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা অপর দিকে বিদেশী এয়ারলাইন্স থেকে পাচ্ছে মাসিক বড় অংকের মাসোয়ারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বেসরকারি এয়ারলাইন্সের শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এয়ারলাইন্স ব্যবসা খুবই স্পর্শকাতর। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এ ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে, যে কোনো এয়ারলাইন্সকে তাদের দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক ও বহর পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়।

এটি এক বছর থেকে ৫ বছরের জন্যও হয়ে থাকে। সেখানে সিভিল এভিয়েশন যদি ২০ দিন থেকে তিন মাসের জন্য এওসি ইস্যু করে থাকে তাহলে ওই এয়ারলাইন্স কোনোভাবে তাদের সুষ্ঠু বাণিজ্যিক পরিকল্পনা তৈরি করতে পারবে না। এমনকি বিনিয়োগ পর্যন্ত বাড়াতে পারবে না। সাধারণত ছোট আকারের একটি এয়ারক্রাফট কিনতে ৫শ’ থেকে ৮শ’ কোটি টাকা লাগে।

সেখানে কোনো কারণে যদি এওসি নবায়ন না হয় তাহলে পুরো বিনিয়োগই ধ্বংসের মুখে পড়বে। গত সাত বছরের হিসাব অনুযায়ী, বেবিচক এওসি নবায়নের সর্বনিু সময়সীমা ৮ দিন থেকে সর্বোচ্চ একবছর পর্যন্ত নির্ধারণ করে সার্টিফিকেট দিয়েছে বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে। এ ছাড়া অন্যান্য বেসরকারি এয়ারলাইন্সের অবস্থাও একই।

এ প্রসঙ্গে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী বলেন, যে কোনো এয়ারলাইন্সের জন্য এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি এওসি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। তিনি বলেন, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ১৬শ’ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।

সাড়ে ৬ বছরে ১১টি এয়ারক্রাফট ক্রয় করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ১ লাখ ৩০ হাজার শেয়ারহোল্ডারের এই এয়ারলাইন্সকে সর্বশেষ ৮৩ দিনের জন্য এওসি দিয়েছে বেবিচক। শুধু তাই নয়, ৭ বারের স্থলে এ পর্যন্ত ১৮ বার এওসি ইস্যু করা হয়েছে। তার মতে, একবার এওসি ইস্যুর পর পরবর্তী এওসি নবায়নের জন্য প্রতিটি প্রাইভেট এয়ারলাইন্সকে সার্বক্ষণিক বেবিচকের নির্দিষ্ট শাখায় শরণাপন্ন হতে হয়।

তবে বেবিচক পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি) গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএসএম নাজমুল আনাম জানান, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে সরকার ৭৭ কোটি টাকা পাবে। নানা চেষ্টা-তদবির করেও এই টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। সিভিল এভিয়েশনকে টাকা দিচ্ছে না অথচ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিচ্ছে। এটা এক ধরনের প্রতারণা।

তিনি বলেন, এমনিতে বাংলাদেশ আন্তজাতিকভাবে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে। কিছুদিন আগে সিগনিফিকেন্ট সেফটি কনসার্নের (এসএসসি) তালিকায়ও নাম ছিল। অনেক চেষ্টা-তদবির করে এসএসসি থেকে নাম কাটাতে হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও নানা চেষ্টা করেও দেশের কতিপয় বেসরকারি এয়ারলাইন্সকে আইনকানুনের আওতায় আনা যাচ্ছে না।

তার মতে, বকেয়া টাকা পরিশোধের জন্য শর্ত সাপেক্ষে ২-৩ মাসের জন্য এওসি ইস্যু করা হয়। কিন্তু তারপরও তারা টাকা দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সর্বশেষ শর্ত সাপেক্ষে ৮৩ দিনের এওসি দেয়া হয়েছে ইউনাইটেডকে। এবার টাকা না দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বিপরীতে এ পর্যন্ত ৮ দিন, ২৪ দিন, ১ মাস, ২ মাস, ৩ মাস, ৬ মাস, ৭ মাস, ৯ মাস মেয়াদি এওসি ইস্যু করা হয়েছে। সর্বশেষ ইস্যুকৃত এওসির মেয়াদ ২ মাস ২৩ দিন। যার মেয়াদ শেষ হবে ২৯ জুন ২০১৪ তারিখ। বর্তমানে দেশে এওসিধারী তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স আছে।

এর মধ্যে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বহরে ২টি এয়ারবাস-৩১০, ৫টি এমডি-৮৩, তিনটি এটিআর-৭২ ও একটি ড্যাশ-৮সহ মোট এগারোটি এয়ারক্রাফট রয়েছে। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ২টি ড্যাশ-৮ ও ২টি বোয়িং ৭৩৭-সহ ৪টি এয়ারক্রাফট ও নভো এয়ারের আছে ২টি এম্ব্রায়ার ১৪৫ মডেলের এয়ারক্রাফট।

দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর অভিযোগ দেশীয় বিমান সংস্থার জন্য বেবিচক যেসব চার্জ ধার্য করেছে তাতে নানা অসঙ্গতি ও বৈষম্য রয়েছে। এ কারণে অনেক এয়ারলাইন্স টাকা দিচ্ছে না। এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য তারা অসংখ্যবার চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয় ও বেবিচককে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

বেবিচক ইউনাইটেড এয়ারের কাছে ৭৭ কোটি টাকা বকেয়ার কথা জানালেও ইউনাইটেড বলছে, তাদের হিসাব অনুযায়ী বকেয়া ৪২ কোটির কম। তা ছাড়া ইতিমধ্যে তারা জ্বালানি তেলে ট্যাক্স ও সারচার্জ কমানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। তাদের আবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে আছে।

তারা ইতিমধ্যে বেবিচককে জানিয়েছে সরকার তাদের আবেদন অনুযায়ী বকেয়া নির্ধারণ করে দিলেই পুরো টাকা পরিশোধ করে দেবে। ইতিমধ্যে গত মাসে সাড়ে ৩ কোটি টাকা দিয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করবে। দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর অভিযোগ সিভিল এভিয়েশনের ধার্যকৃত অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ তাদের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা।

এর মধ্যে রয়েছে, ল্যান্ডিং, রুট নেভিগেশন, পার্কিং ও সিকিউরিটি অন্যতম। একটি ড্যাশ-৮ এয়ারক্রাফট যতবার অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট শেষে অবতরণ করবে ততবার তাদের ২ হাজার ৪০৩ টাকা এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য ৩৩ হাজার ৯২৪ টাকা দিতে হচ্ছে। তাদের মতে, বিশ্বের কোনো দেশেই অভ্যন্তরীণ এয়ারলাইন্সের জন্য এই চার্জ নেই।

এ ছাড়া এটিআর-৭২ এয়ারক্রাফটের জন্য ৩ হাজার ৯২২ টাকা এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য ৪৬ হাজার ৩১৫ টাকা দিতে হয়। এম্ব্রায়ার-১৪৫-এর জন্য ৪ হাজার ১৭৫ টাকা এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ৪৬ হাজার ৮৩২ টাকা। বোয়িং-৭৩৭-এর ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ১৮ হাজার ৬১৯ টাকা এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শেষে দেশে অবতরণের জন্য ১ লাখ ১২ হাজার ৩৪০ টাকা চার্জ দিতে হচ্ছে।

এমডি-৮৩ এয়ারক্রাফটের ক্ষেত্রে এই চার্জ অভ্যন্তরীণ ১৯ হাজার ১৪৬ টাকা আন্তর্জাতিক ১ লাখ ২০ হাজার ৪১৮ টাকা, এয়ারবাস ৩১০ এয়ারক্রাফটের জন্য অভ্যন্তরীণ ৫২ হাজার ৩৩১ এবং আন্তর্জাতিক ২ লাখ ৮০ হাজার ৫০৮ টাকা।

দেশীয় এয়ারলাইন্স মালিকদের বক্তব্য, বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যবহৃত ড্যাশ-৮, এটিআর-৭২, এম্ব্রায়ার-১৪৫, বোয়িং-৭৩৭, এমডি-৮৩ কিংবা এয়ারবাস-৩১০ এয়ারক্রাফটের ক্ষেত্রে বিদেশ প্রত্যাগত ফ্লাইটের জন্য ডমেস্টিকের তুলনায় প্রকারভেদে বিভিন্ন এয়ারক্রাফটের অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ প্রায় ৫ থেকে ১৪ গুণ বেশি।

এটি মূলত আন্তর্জাতিক রুটে দেশীয় এয়ারলাইন্সকে ফ্লাইট পরিচালনায় নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া পার্কিং চার্জও বিদেশী এয়ারলাইন্সের মতো সমহারে দিতে হচ্ছে। এয়ারবাসের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৪৯২ মার্কিন ডলার, এমডি-৮৩-এর জন্য ১৭৮ মার্কিন ডলার এবং বোয়িং-৭৩৭-এর জন্য ১৭১ মার্কিন ডলার।

অথচ ভারত তাদের দেশীয় এয়ারলাইন্সের স্বার্থে ৮০ আসনের নিচের কোনো উড়োজাহাজের জন্য কোনো ল্যান্ডিং চার্জ নিচ্ছে না। অভিযোগ, সরকারি-বেসরকারি এয়ারলাইন্সের জন্য দেশের বিমানবন্দরে কোনো হ্যাঙ্গার সুবিধা নেই। মেনটেনেন্স চেক-আপ, সি চেক, ডি চেক, এ চেকসহ নানা প্রকার চেকের জন্য তাদের বিদেশে পাড়ি দিতে হচ্ছে। হ্যাঙ্গার সুবিধা থাকলে প্রতিবছর প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোর কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হতো।

– মুজিব মাসুদ

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.