রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় স্থানান্তরের জন্য সরকারের কয়েক দফা সময়সীমা ও মন্ত্রীর আলটিমেটামের মধ্যেও তার বাস্তবায়ন এখনো অনিশ্চিত। সর্ব শেষ গত গত ৩১ মার্চ আলটিমেটাম শেষে ১ এপ্রিল থেকে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। পরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের মাধ্যমে বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি ট্যানারিগুলোকে সাত দিন সময় দেয়ার সুপারিশ করবেন। এরপর প্রস্তুতি নিতে ট্যানারিগুলোকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তারা হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া নিতে পারবে। ১১ এপ্রিল থেকে আবার সরকার আগের অবস্থানে চলে যাবে। এ পর্যন্ত ট্যানারিগুলোকে স্থানান্তরের জন্য বেশ কয়েকবার আলটিমেটাম দিলেও তা পালিত হয়নি। অথচ সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর নির্মাণকাজের গতি দেখে বুঝা যাচ্ছে কোনোভাবেই কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ট্যানারি মালিকদের কাছে তা হস্তান্তর করা সম্ভব হবে না। প্রকল্পের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) নির্মাণকাজও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন না হওয়ায় তা বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে স্থানান্তরের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিইটিপির চারটি মডিউলের মধ্যে দু’টির কাজ শেষ হলে ইতোমধ্যে সেই দু’টিতে ডেমো টেস্ট করা হয়। গত দুই সপ্তাহ ধরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে খোলা আকাশের নিচে রোদ আর বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রপাতি। চামড়া শিল্পনগরীর নির্মাণকাজ ধীরগতিতে চলার কারণে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে চামড়া শিল্পনগরীর কাজ সম্পূর্ণ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন দেখা যায়, গোটা প্রকল্প এলাকায় রাস্তার পাশে এবং কারখানার ভেতরে ইট-বালু-পাথর ও রড-বাঁশের স্তূপ দেখা গেলেও শিগগিরই কারখানা স্থানান্তর করা হবে, তেমন কোনো তোড়জোড় নেই। বাড়তি কোনো ব্যস্ততাও চোখে পড়ে না। ট্যানারি মালিকদের কাছে ১৫৫টি প্লটের বরাদ্দের মধ্যে বেশির ভাগেই কাজ শুরু হয়েছে।
তবে যেখানে দেখা যাওয়ার কথা উঁচু উঁচু ভবন সেখানে দেখা যাচ্ছে কোনোটি এক তলা, আবার কে নোটি দোতলা, কিছু মাটির নিচে, আবার কিছু কাজ বন্ধ রয়েছে। একটি প্লটেরও সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়নি। যেসব প্লটের কাজ চলছে তা আবার ধীরগতি। পুরো প্রকল্পের মধ্যে এপেক্স ট্যানারি লিমিটেড, রিলায়েন্স ট্যানারি লিমিটেড ও ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্ক্যান লিমিটেডসহ কয়েকটির কাজের কিছুটা গতি লক্ষ করা গেছে। তাদেরও কাজ শেষ হতে দুই-তিন মাস সময় লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। ইতোমধ্যে এসব ট্যানারি কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার জন্য ড্রাম বসানো শুরু করেছে।
চামড়া শিল্পনগরীর এপেক্স ট্যানারি লিমিটেড প্রজেক্ট ইনচার্জ লিয়াকত আলী বলেনÑ ২২ বিঘা জায়গা নিয়ে তাদের ফ্যাক্টরি। এক লাখ পাঁচ হাজার স্কয়ার ফিটের মধ্যে তাদের মূল ফ্যাক্টরি। বেইজমেন্টসহ তাদের পাঁচ তলা ভবন হবে। কাজ শেষ হয়েছে বেইজমেন্টসহ দোতলা পর্যন্ত। তাদের পুরো কাজ শেষ হতে দুই মাস সময় লাগবে। মো: কায়ছার আলী চৌধুরী বলেন, বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এক ট্যানারি থেকে অন্য ট্যানারির সাথে সংযোগ ড্রেনগুলো এখনো করেনি। তিনি আরো বলেন- কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) সাথে সংযোগের জন্য মূল লাইনটিও এখনো সম্পূর্ণ না হওয়ায় আমাদের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। কথা হয় সিকিউরিটি ইনচার্জ রফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, তারা একটি ফাসিং মেশিন বসিয়েছেন এবং এক লাখ ৩০ হাজার পিস ওয়েট ব্লু চামড়া নিয়ে আসা হয়েছে সাভারে তাদের কারখানায়।
অন্য দিকে রিলায়েন্স ট্যানারি লিমিটেডের কারখানার তৃতীয় তলার কাজ চলছে। কথা হয় রিলায়েন্সর মালিক শাহজাহানের ভাগিনা মিজানুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, তাদের যে ড্রামগুলো বসানো হয়েছে গ্যাস ও পানির লাইন না থাকায় তাতে কাজ শুরু করতে পারছেন না। তিনি আরো জানান, ঢাকার হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশে বাধা থাকায় সে চামড়াগুলো তারা সাভারে নিয়ে এসেছেন এবং বেশ কিছু শ্রমিক কাঁচা চামড়াগুলোতে লবণ দিয়ে রাখছেন।
কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি): সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণের কাজ ২০১৪ সালের মার্চে কাজ শুরু হয়। চারটি মডিউলের মধ্যে দু’টি শেষ করেছে। ইতোমধ্যে দু’টিতে ডেমো টেস্ট করা হয়েছে। বিসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, দু’টি মডিউলে ৫০টি ট্যানারির বর্জ্যরে কাজ করা যাবে। এ দিকে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে খোলা আকাশের নিচে রোধ আর বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ। গত সোমবার বেলা সাড়ে ৩টায় সরেজমিন কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ দেখতে গেলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সিইটিপির সংশ্লিষ্ট কাউকে পাওয়া যায়নি। এ সময় দেখা হয় সিকিউরিটি গার্ড মো: ইয়াছিনের সাথে। কেউ নেই কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, গত দুই সপ্তাহ চায়না কম্পোনির লোকেরা শ্রমিকদের মজুুরির টাকা দিতে পারছেন না সে জন্য কাজ বন্ধ রয়েছে।
ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ডব্লিউটিপি) : সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে পানি সরবরাহের জন্য ১০ পাম্প বসানো হয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে ৯ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করবে। এর মধ্যে এক লাখ লিটার ড্রিংকিং আর সাড়ে আট লাখ লিটার ট্যানারিগুলোতে সরবরাহ করা হবে। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ডব্লিউটিপি)’ সুপারভাইজার খন্দকার শওকত আলী জানান, গত সোমবার পরীক্ষামূলক ডিপটিউবওয়েল চালু করা হয়েছে। আমাদের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যেকোনো সময় আমরা চালু করতে পারব।
উদ্বোধন ও জায়গার পরিমাণ : সাভারের তেতুঁলঝোড়া ইউনিয়নের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় ২০০৪ সালে চামড়া শিল্পনগরী উদ্বোধন করা হয়। ২০০ একর জায়গার ওপর এ ট্যানারি শিল্প করা হয়, যেখানে রয়েছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি, বিদ্যুতের দু’টি সাব- স্টেশন, গ্যাস লাইনের ব্যবস্থা, মসজিদের জায়গা, ফায়ার সার্ভিস, সিইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার )। চামড়া শিল্পনগরীতে ১৫৫টি প্লট ট্যানারি মালিকদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহম্মেদ জানান, সরকার ৩১ মার্চের পর কাঁচা চামড়া হাজারীবাগে প্রবেশে বাধা দেয়ার পর এখন ১০ এপ্রিল পর্যন্ত কাঁচা চামড়া প্রবেশে অনুমতি দিয়েছে। পরে আবার বাধা দেয়া হলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না। এতে দেশের লাখ লাখ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় সহসা চামড়া শিল্প সাভারে স্থানান্তর সম্ভব নয়। আমরা আশা রাখি জুন মাসে চামড়া শিল্প সাভারে স্থানান্তর করতে পারব।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নির্বাহী প্রকৌশলী আবুবকর সিদ্দিক জানান, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ শেষের দিকে। বিশাল কাজ, সে জন্য আপাতত আর্থিক সঙ্কটের জন্য এখন সিইটিপির নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক আব্দুল কাউয়ূম জানান, সিইটিপির দু’টি মডিউল ইতোমধ্যে আমরা ডেমো টেস্ট করিয়েছি। এ দু’টি মডিউলে ৪০-৫০টি ট্যানারির বর্জ্য গ্রহণ সম্ভব। জুনের মধ্যে বাকি দু’টি মডিউলের কাজ আমারা শেষ করব। যেকোনোভাবেই হোক আমাদের ২০১৬ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে। এ বছরই আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ। আমরা ট্যানারি মালিকদের সাময়িক একটি সুযোগ দিয়েছি। ১০ এপ্রিলের পর আমরা কোনোভাবেই হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ করতে দেবো না।
আরও খবর