পাসপোর্ট অধিদফতরের আঞ্চলিক অফিসগুলো দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এসব অফিসে অলিখিতভাবে দালাল নিয়োগ দিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ্যে চলে ঘুষের কারবার।
এভাবে দেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে কর্মকর্তাদের নামে প্রতি মাসে অন্তত ১২ কোটি টাকা আদায় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঘুষের এ টাকা বিভিন্ন হারে ভাগ হয়ে যথাসময়ে পৌঁছে যাচ্ছে প্রধান কার্যালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের পকেটেও।
সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে পাসপোর্ট অধিদফতরের আঞ্চলিক অফিসগুলোর ঘুষ বাণিজ্যের এ চিত্র উঠে এসেছে, যা ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যালয়ে পেশ করা হয়েছে। আশার কথা, করোনা পরিস্থিতির কারণে কিছুটা বিলম্ব হলেও সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দুদকের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরসহ এর আঞ্চলিক অফিসগুলোর দুর্নীতি সমূলে উৎপাটিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
হয়রানি ও দুর্নীতিমুক্ত সেবাপ্রাপ্তি জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হলেও বাস্তবতা হল, দেশে বর্তমানে ঘুষ ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যেন অলৌকিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি দেশের সরকারি সেবা খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম ও হয়রানির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে যে জাতীয় খানা জরিপ প্রকাশ করেছিল, সেখানে দেখা গেছে ২০১৭ সালে সেবা খাতে ঘুষের লেনদেন হয়েছে অন্তত ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।
আশ্চর্যের বিষয় হল, আমাদের সেবা খাতে যেখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, সেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লির আম আদমি পার্টির কেজরিওয়াল সরকার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তারা চালু করেছে সরকারি সেবার হোম ডেলিভারি সার্ভিস প্রকল্প। একটি নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করলে সহায়তার জন্য অকুস্থলে পৌঁছে যাবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যদি কারও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন হয়, তাহলে নির্ধারিত কল সেন্টারে ফোন করে নিজের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ও ঠিকানা জানাতে হবে।
এরপর এজেন্সি থেকে একজন মোবাইল সহায়ক কে নিয়োগ দেয়া হবে। সে সরাসরি আবেদনকারী ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সংগ্রহ করবে। এজন্য আবেদনকারীকে একদিন ড্রাইভিংয়ের পরীক্ষার জন্য মোটর লাইসেন্সিং অফিসে যেতে হবে।
এতে পাস করলে বাড়িতেই ৫০ রুপি ফি’র বিনিময়ে পৌঁছে দেয়া হবে লাইসেন্স। একইভাবে পাসপোর্ট, আয়কর সনদ, রেশনকার্ডসহ ৪০টি সরকারি সেবা ঘরের দরজায় পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে দিল্লি সরকার। প্রশ্ন হল, দিল্লিতে যখন সরকারি সেবা মানুষের দরজায় পৌঁছে দেয়ার নাগরিকবান্ধব প্রকল্প চালু হয়েছে, তখন এদেশের অবস্থা কী?
টিআইবির জরিপ বলছে প্রকাশিত ১৬টি সরকারি সেবা খাতের জরিপ ফলাফল অনুযায়ী সবক্ষেত্রেই কম বেশি দুর্নীতি হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে শীর্ষ সাতটি সেবা খাতের, বাকি পাঁচটি হল পাসপোর্ট, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য।
পাসপোর্ট অধিদফতরের আঞ্চলিক অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাগামহীন দুর্নীতি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব করছে এবং এর ফলে প্রান্তিক ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী ক্ষতির শিকার হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখার পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রবাসী শ্রমিকরা পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
প্রবাসী শ্রমিকসহ দেশের সাধারণ মানুষ যাতে প্রয়োজনের সময় কোনোরকম হয়রানি ও ভোগান্তি ছাড়া পাসপোর্ট পেতে পারে, সেজন্য সরকার পাসপোর্ট অধিদফতরসহ এর সব আঞ্চলিক অফিস দুর্নীতিমুক্ত করার পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য।
-যুগান্তর সম্পাদকীয়