এভিয়েশন নিউজ: সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার ১৬ বছরেও এটি পূর্ণতা পায়নি। রিফুয়েলিং সিস্টেম প্রকল্প বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিমানে জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকার কারণেই ওসমানীতে এযাবতকালেও দেখা মিলেনি বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর। এ নিয়ে প্রবাসী ও সিলেটবাসীর মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষও দীর্ঘদিনের। অবশেষে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের পথে। রিফুয়েলিং সিস্টেম স্টেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে সম্প্রতি। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হলেই দেশের অন্যতম ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখা মিলবে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর। ওঠা-নামা, অবতরণ-উড্ডয়ন শুরু করবে সুপরিসর উড়োজাহাজ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রিফুয়েলিং সিস্টেম স্টেশনের কাজ শেষ হওয়ার পর চালুর লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষ-নিরীক্ষা ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে আগামী ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে পারেন। ওই দিনই বিমানের সিলেট-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট চালুরও ঘোষণা আসতে পারে। আর আগামী বছরের জানুয়ারি থেকেই এ বিমানবন্দরে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রা শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবাসী ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বিমানবন্দরে বিদেশি এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ ওঠানামা করলে এ অঞ্চলের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ হবে। আর বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন প্রবাসীরাও।
বর্তমানে দেশে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে আধুনিক এয়ারক্র্যাফট রিফুয়েলিং সুবিধা থাকলেও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ সুবিধা এতোদিন ছিল না। ফলে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ওসমানীতে ফ্লাইট পরিচালনায় এগিয়ে আসেনি। আর দেশি যেসব এয়ারলাইন্স ওসমানীতে ফ্লাইট অপারেশন করছে তারাও বিমানবন্দরে এয়ারক্র্যাফট রিফুয়েলিং ব্যবস্থা না থাকায় নানা প্রকার সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। অনেক সময় এসব এয়ারলাইন্স দুর্ঘটনাকবলিত হচ্ছে ও সিডিউল ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য এবং সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ও এ বিমানবন্দরের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রায় চার বছর আগে সরকার রিফুয়েলিং স্টেশন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটিজ প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটিজ প্রজেক্ট বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় পদ্মা অয়েল কোম্পানি। এ কোম্পানি নগরীর দক্ষিণ সুরমায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ডিপো স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়। এ জন্য রেল কর্তৃপক্ষ ১ একর ভূমি পদ্মা অয়েল কোম্পানিকে হস্তান্তর করে। পদ্মা অয়েল কোম্পানির সিলেটের মার্কেটিং অফিসার মীর ফখর উদ্দিন জানান, ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন সহকারী ব্যবস্থাপক জানান, রিফুয়েলিং স্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হয়েছে। তিনি জানান, দু’টি স্থানে চলছে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। এর একটি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় পদ্মা ওয়েলের ডিপোতে এবং অন্যটি বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে। দক্ষিণ সুরমায় এক একর জায়গায় নির্মিত হয়েছে রিফুয়েলিং স্টেশনের রিজার্ভ স্টেশন। এর কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান তিনি।
দক্ষিণ সুরমায় রিজার্ভ স্টেশনে নির্মাণ করা হয়েছে দ্বিতল অফিস ভবন, তিনটি স্টোরেজ ট্যাংঙ্ক, পাইপ লাইন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেস্ট হাউজ, গ্যারেজ, অফিসার্স রুম ও স্টাফ রুম এবং দুটি ডিসপেনসার ও ফিল্টারিং ব্যবস্থা। অন্যদিকে বিমানবন্দরে নির্মিত হয়েছে তিনটি স্টোরেজ ট্যাঙ্ক, হাইড্রেন্ট লাইন, ডিপো রিফুয়েলার ডিসপেনসার ও ফিল্টার এবং জেট ফুয়েল পরিবহনের জন্য ব্রিজার অর্থাৎ বড় ট্যাঙ্ক লরি। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক মো. হাফিজ আহমদ বলেন, ‘রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণ করছে পদ্মা অয়েল কোম্পানি। নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়েছে বলে জেনেছি।’ তিনি বলেন, বিমানবন্দরে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও শুধুমাত্র রিফুয়েলিং ব্যবস্থা না থাকায় সিলেট থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ ছিল। রিফুয়েলিং সুবিধা হয়ে গেলে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক রূপ পাবে এ বিমানবন্দর।
ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৯৬ সালে। জোরেশোরে শুরু হয় রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ। ১৯৯৮ সালের ২০ ডিসেম্বর ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে উন্নীত করা হয়। প্রথমদিকে বেশ কিছুদিন লন্ডন থেকে সরাসরি সিলেটে ফ্লাইট পরিচালনা করা হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমান নিজেই বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজে হাত দেন। ওই সময় ওসমানীকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত করতে পর্যায়ক্রমে দুটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। উন্নয়ন কাজ শেষে ২০০৬ সালের ১২ মার্চ দুবাই থেকে আসা একটি এয়ারবাস (বিজি০২০) অবতরণের মাধ্যমে ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর প্রায় দেড় বছর ওসমানীতে বিদেশি ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণ বন্ধ ছিল।
২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইফতেখার আহমদ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় লন্ডন থেকে দুবাই হয়ে ওসমানীতে অবতরণ করে বাংলাদেশ বিমানের একটি সুপরিসর এয়ারবাস (ডিসি-১০)। ৩০১ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এয়ারবাসটি ২৭৫ জন যাত্রী নিয়ে ওসামানীতে অবতরণ ও যাত্রী নিয়ে পুনরায় উড্ডয়ন করে। এর মাধ্যমে সুপরিসর বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সব সম্ভাবনা দেখা দিলেও কেবল রিফুয়েলিং সিস্টেম না থাকায় পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি ওসমানীকে। জ্বালানি সুবিধা না থাকায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর বিমানও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারেনি।
২০১০ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওসমানী বিমানবন্দরে রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ২০১২ সালে বিমানের ‘কনস্ট্রাকসন এভিয়েশন রিফুয়েলিং ফেসিলিটিজ’ (স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উড়োজাহাজে জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থা) নামে সিলেটে রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনকন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রায় ৫১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় পদ্মা অয়েল কোম্পানি। সিলেট ওভারসিজ সেন্টার সূত্র জানায়, সিলেট অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক লোক জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রবাসে রয়েছেন। যুক্তরাজ্য প্রবাসী ৫ লাখ বাংলাদেশির ৯৫ ভাগই সিলেটের। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ৬ লাখ বাংলাদেশির অর্ধেকই এ অঞ্চলের। দেড় লাখ ইতালি প্রবাসী ও দেড় লাখ কানাডা প্রবাসীর অর্ধেকেরও বেশির মূল ঠিকানা সিলেট। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের উল্লেখযোগ্য অংশ সিলেটের বাসিন্দা। সারা বছর তারা দেশে আসা যাওয়া করেন। এর মধ্যে জুন-জুলাই এবং নভেম্বর-ডিসেম্বরে তাদের আনাগোনার মাত্রাটা একটু বেশি থাকে।
এতোসব যাত্রীকে একা সামাল দিতে পারে না বাংলাদেশ বিমান। তাই যাত্রীদের ভরসা করতে হয় বিদেশি এয়ারলাইন্সের ওপর। তাছাড়া রুচিভেদের কারণেও অনেকে বিদেশি বিমানের ওপর আস্থা রাখেন। কিন্তু বিদেশি কোনো এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ ওসমানীতে না নামায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। এর ওপর বাংলাদেশ বিমানের সব ফ্লাইটও সরাসরি সিলেট আসে না। এসব দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে সিলেটের প্রবাসীরা বিদেশি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চলাচলের সুবিধাসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দাবি করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু তাদের সে দাবি আজও মেটেনি। সিলেট ওভারসিজ সেন্টারের নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুল আলম বলেন, ওসমানী পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপ লাভ করলে প্রবাসীরা দেশের প্রতি আরো আকৃষ্ট হবেন। সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডস্ট্রির পরিচালক তাহমিন আহমদ বলেন, রিফুয়েলিং সিস্টেম স্থাপিত হলে ওসমানীতে এয়ারকার্গো নামবে। এতে সিলেট থেকে বিদেশে বিভিন্ন প্রকার পণ্যসামগ্রী রপ্তানি সহজ হবে। সরকারের রাজস্বও বৃদ্ধি পাবে। তিনি দ্রুত রিফুয়েলিং সিস্টেম চালুর দাবি জানান।
– আবদুল মুকিত