একজন বৈমানিকের বর্ণনায় ৩ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ

নাজমুল আহসান শেখ : নভেম্বরের শুরুতেই আমাকে জানানো হলো, জিয়া আগ্রহী না হওয়ায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফই নেতৃত্ব দেবেন। পরবর্তী সময়ে আমি বুঝতে পারি, জিয়া সবসময় মুখে এক আর অন্তরে আরেকরকম ছিলেন (অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক অফিসার জিয়াউর রহমান পরবর্তীকালে ক্ষমতা দখল করলে তার মন্ত্রিসভা অনেক সাবেক পাকিস্তানি আইএসআই এবং মিলিটারি ইন্টিলিজেন্সের অফিসার দ্বারা পূর্ণ ছিল!)।

২ নভেম্বর মধ্যরাতে লিয়াকত আমার বাসায় আসে এবং জানায়, ‘আমরা আজ সকালে অভিযান শুরু করব।’ পরিকল্পনামতো মধ্যরাতে মেজর ইকবাল বঙ্গভবন থেকে পদাতিক বাহিনী নিয়ে চলে আসেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার দলকে কাজে নিয়োজিত করি। লিয়াকত নিখুঁত এক পরিকল্পনা করেছিল। ফ্লাইট লে. মিজান (যোগাযোগ) সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা অকেজো করে ফেলেন, যাতে অন্য কেউ যোগাযোগ করতে না পারে বা এই অভিযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারে।

আর্মামেন্ট অফিসার অস্ত্রাগার থেকে প্রয়োজনীয় ‘পড ও রকেট’ সরবরাহ করেন। গ্রাউন্ড কমব্যাট কমান্ডার ফ্লাইট লে. ওয়ালী খন্দকার বিমানবন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, যেন কেউ বাইরে থেকে প্রবেশ করতে না পারে। আমাদের একজন বন্ধু (বাংলাদেশ বিমানের পাইলট) বিমানের মাইক্রোবাস দিয়ে আমাদের পরিবহণে সাহায্য করেন; কারণ আমরা যত কম সম্ভব বিমানবাহিনীর জনবল ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারও (এটিসি) প্রস্তুত ছিল। আমি ক্রুদের সঙ্গে নিয়ে ভোর ৪টার মধ্যেই হেলিকপ্টার ও বিমান যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই অস্ত্রসজ্জিত একটি হেলিকপ্টার এবং দুটি মিগ আকাশে উড়ে যায়!

৩ নভেম্বর ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সম্পূর্ণ অস্ত্র ও গোলা-বারুদসহ কোনো হেলিকপ্টার আকাশে উড়ে! স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম (বীর উত্তম) এবং আমি সেই হেলিকপ্টারের দায়িত্বে ছিলাম। ফ্লাইট লে. জামাল ও সালাউদ্দিন ছিলেন মিগ ২১-এর দায়িত্বে। ফ্লাইট লে. কাইউম, পাইলট অফিসার দিদার এবং আরও কয়েকজন জুনিয়র অফিসার ‘ব্যাক-আপ’ হিসাবে অপেক্ষমাণ ছিলেন। ফ্লাইট লে. ওয়ালী খন্দকার ছিলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে। ফ্লাইট লে. মিজান যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন। ফ্লাইট লে. হক রকেট ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেন। পরিবহণ স্কোয়াড্রন স্টান্ডবাই ছিল স্কোয়াড্রন লিডার শাখাওয়াতের নেতৃত্বে। এটিসির দায়িত্বে ছিলেন পাইলট অফিসার আখতার। স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত ছিলেন সম্পূর্ণ অভিযানের সমন্বয়কারীর দায়িত্বে।

ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মিগ ও হেলিকপ্টার আকাশে উঠে যায় এবং বঙ্গভবন ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থানরত ট্যাংকগুলোর ওপর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে চক্কর দিতে থাকে। ট্যাংকগুলো বঙ্গভবন পাহারা দিচ্ছিল। এমআই আট হেলিকপ্টারটি ৬৪টি ট্যাংকবিধ্বংসী রকেট বহন করেছিল; এবং প্রতিটি মিগ ২১ পর্যাপ্তসংখ্যক ট্যাংকবিধ্বংসী রকেট বহন করছিল। বঙ্গভবন ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থানরত ট্যাংকগুলো এবং রেডিও অফিস সবসময়ই আমাদের নিশানার মধ্যে ছিল। আমরা আক্রমণ করার জন্য লিয়াকতের নেতৃত্বাধীন গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের কাছে অনুমতি চাই, কিন্তু আমাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

ট্যাংকগুলো আমাদের নিশানার মধ্যে আসছিল আর আমরা আক্রমণ করার জন্য অনুমতি চাচ্ছিলাম। আমরা চার-চারবার অনুমতি চেয়েছিলাম, আর প্রতিবারই আমাদের অপেক্ষা করতে বলা হয়। পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলাম, ‘রক্তপাত এড়ানো’র জন্য জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ১৫ আগস্টের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে সমঝোতা হয়! জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় ১৫ আগস্টের পরিকল্পনাকারীরা নিরাপদে বিদেশে চলে যাওয়ার নিশ্চয়তার বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়; যা আমাকে সত্যিই অবাক ও হতাশ করেছিল।

আমরা সর্বমোট ৪৫ মিনিট আকাশে ছিলাম এবং এই ৪৫ মিনিটই ১৫ আগস্টের পরিকল্পনাকারীদের আত্মসমর্পণ করানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। আমরা প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়েই অবতরণ করলাম এবং স্টান্ডবাই অবস্থায় থাকলাম। কিন্তু আমাদের মনের অনেক প্রশ্নই অমীমাংসিত থেকে যায়। জানতে পারলাম, এয়ার কমডোর বাশারকে ক্যাপ্টেন ইকবাল গৃহবন্দি করেছেন। এ খবর আমাদের এবং বিশেষ করে আমাকে খুবই বিরক্ত করে, কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় এয়ার কমডোর বাশার আমার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এ খবরের সবচেয়ে জঘন্য দিক হলো, গুজব ছড়ানো হয় আমি তাকে গৃহবন্দি করেছি, যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ, আমি সেই সময় হেলিকপ্টার প্রস্তুত করছিলাম। পরবর্তীকালে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়, ক্যাপ্টেন ইকবালের সঙ্গে নামের মিল থাকায় এ বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল।

সকাল ৯টার দিকে স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত এবং আমি মোশতাক সরকার কর্তৃক নিয়োজিত নতুন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াবকে খুঁজে বের করি (এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব মুক্তিযুদ্ধের সময় জার্মানিতে অবস্থান করলেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি এবং পাকিস্তানের কোহাটে বেইস কমান্ডার ছিলেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাকের আহ্বানে ফিরে এসেছিলেন)। আমরা জানতাম না এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব কোথায় লুকিয়েছিলেন। আমাদের এক সিনিয়র কর্মকর্তা উইং কমান্ডার সুলতান মাহমুদকে (পরবর্তী সময়ে বিমানবাহিনী প্রধান) ধন্যবাদ, যিনি আমাদের জানান এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধান এবং আরেক সন্দেহজনক ব্যক্তি এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলামের বাসায় লুকিয়ে আছেন।

স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত এবং আমি বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্যসহ এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলামের বাসায় যাই এবং এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াবকে পলাতক অবস্থায় দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে আসি; এবং তাকে ৪র্থ বেঙ্গলের অপারেশন হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাই। সেখানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ, কর্নেল শাফায়াত, কর্নেল হুদা, লে. কর্নেল হায়দার এবং অন্য অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যখন আমরা এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াবকে ৪র্থ বেঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি আমার হাত ধরে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন তাকে যেন রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি উত্তরে বলেছিলাম, এ কাজ আমার পক্ষে সম্ভব নয়; কারণ আমি একজন জুনিয়র অফিসার। কী বিচিত্র এ মানুষটি! (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব কট্টর পাকিস্থানপন্থি হওয়ায় তার মৃত্যুর পর পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে তার বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। -অনুবাদক)।

৪র্থ বেঙ্গলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে দেখতে পেলাম ব্রিগেডিয়ার মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করছেন এবং নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এমএইচ খান তা দেখছেন। কর্নেল হুদা, লে. কর্নেল হায়দার এবং লে. কর্নেল জাফর ইমাম অত্যন্ত হতাশভাবে তাকিয়ে আছেন। কর্নেল হুদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইকবাল, কিচ্ছু হবে না।’

আমরা এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াবকে ৪র্থ বেঙ্গলে ধরে নিয়ে গেলাম। আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম, যখন দেখলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আগ্রহের সঙ্গে এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াবকে স্যালুট করে বললেন, ‘স্যার, আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন, আমরা বিমানবাহিনী প্রধানের জন্য অপেক্ষা করছি, এখন কোরাম পূর্ণ হলো এবং আমাদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব অত্যন্ত ধূর্ত ব্যক্তি ছিলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে খালেদ মোশাররফকে তার সাহস ও কাজের জন্য এমনভাবে অভিনন্দন জানালেন যেন ১৫ আগস্টের খুনিদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই!

যে মুহূর্তে খালেদ মোশাররফ এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াবকে স্বাগত জানিয়ে স্যালুট করেছিলেন, তার পরপরই তিনি আমার দিকে প্রচণ্ড ঘৃণামিশ্রিতভাবে তাকালেন (কারণ আমিই তাকে কিছুক্ষণ আগে গান-পয়েন্টে বন্দি করে এনেছিলাম)। সঙ্গে সঙ্গে আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। আমার ৩ নভেম্বর তখনই শেষ হয়ে যায়। আমি সেই স্থান ত্যাগ করে সোজা বাসায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লে আমার স্ত্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ‘এখন কোরাম পূর্ণ হলো’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত আমি নির্মম ও দুঃখজনক জেলহত্যার বিষয়টি জানতাম না। আমি সন্ধ্যার দিকে ব্যাপারটি জানতে পারি। আমার যেটুকু আশা ছিল তখন পর্যন্ত, তাও নিঃশেষ হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে।

আমি কোনো দোষারোপের খেলা খেলতে চাই না। তবে নেতৃত্বের সমস্যার কারণেই ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হয়। সেই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে থাকা কর্নেল তাহেরের অনুসারীদের তথাকথিত ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ শুরু হয়। তাহেরের অনুগামী সিপাহিরা অন্তরীণ অবস্থা থেকে মেজর জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে এবং জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে। মেজর জেনারেল জিয়া ও তার সমর্থকরা এই ফাঁদে পা না দিয়ে কৌশলে তাহেরকে পরাস্ত করেন।

জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখলের পর এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব এবং রিয়ার অ্যাডমিরাল এমএইচ খানকে আগের পদে বহাল রাখেন, যে সুযোগ এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজে লাগান। তিনি চরম ডানপন্থি, স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থিদের সঙ্গে হাত মেলান এবং জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন; যে কারণে পরবর্তীকালে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।

আমাদের কর্মক্ষেত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আমরা আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের বাসায় আশ্রয় নেই। পাকিস্তানপন্থি কিছু কর্মকর্তা আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় যে, আমরা ভারতের কাছে দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছিলাম এবং আমাদের বন্দি করা হয়; কারণ আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে একদিন এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াবের বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আমাদের ডাকা হয়, তিনি আমাদের উদ্দেশে কথা বলবেন।

সেখানে গিয়ে দেখলাম, আমাদের স্ত্রীদেরও সেখানে ডাকা হয়েছে। স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত আলী খান (বীর উত্তম), স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম (বীর উত্তম), ফ্লাইট লে. জামালউদ্দিন, ফ্লাইট লে. সালাউদ্দিন, ফ্লাইট লে. কাইউম, পাইলট অফিসার দিদার, ফ্লাইট লে. ওয়ালী খন্দকার, ফ্লাইট লে. মিজান এবং আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এয়ারফোর্স প্রভোস্ট ও নিরাপত্তারক্ষীরা সম্পূর্ণ এলাকা পাহারা দিচ্ছিল। সেখানে পাকিস্তানপন্থি বলে বহুল পরিচিত সব কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রভোস্ট মার্শাল উইং কমান্ডার মামুনুর রশীদ এবং এয়ার ইন্টিলিজেন্সের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস।

এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব খুব সহজভাবে বললেন, ‘শাসনতান্ত্রিক (মোশতাক) সরকার’কে উৎখাত করার চেষ্টা করার কারণে আমাদের ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল হবে! ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে অপরিসীম ক্ষমতা প্রদান করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বন্দি করা হয় এবং একটা বাসে করে অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের প্রহরাধীন অবস্থায় রাখা হয়। আমার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ করা হয়-‘শাসনতান্ত্রিক (মোশতাক) সরকার’কে উৎখাত করার চেষ্টা এবং ‘বিমানবাহিনী প্রধানের দিকে বন্দুক তাক করা’।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন হামিদুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে গঠিত ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল ছিল একটি ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’। উইং কমান্ডার সাইফুল আজম, উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান এবং আরও দুজন ছিলেন এ কোর্টের সদস্য, যাদের নাম এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। আমার ধারণা, তাদের কেউই এখন আর জীবিত নেই। স্কোয়াড্রন লিডার রশীদ আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের আইনজীবী ছিলেন এবং উইং কমান্ডার নুরুল ইসলাম ছিলেন প্রসিকিউটর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেনই না, বরং ছিলেন কয়েকজন চরম পাকিস্তানপন্থি।

অতি দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা হয়। প্রথমে লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, পরবর্তীকালে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তন করা হয়। আমাদের সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ফ্লাইট লে. সালাহউদ্দীনকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমাদের সবাইকে বরখাস্ত করা হয়। আমাদের প্রথমে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল এবং পরে অন্যান্য জেলে পাঠানো হয়। জেলে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একই স্থানে রাখা হয়।

সেখানে আমরা রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি, যার মধ্যে কিছু ছিল খুবই হাস্যকর ও আকর্ষণীয়! সবাই আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছিলেন। আমরা জাসদ অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমানের রসবোধ এবং বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেনের সাহচর্য উপভোগ করেছিলাম। আমরা নয় মাস জেলে ছিলাম। এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হলে এমকে বাশার বিমানবাহিনীর নতুন প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি আমাদের মুক্ত করে দেন।

এভিএম সাদরুদ্দিন আমাদের বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে আমাদের পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে অবসর প্রদান করেন, যাতে আমরা অবসরের সব সুযোগ-সুবিধা পেতে পারি। তবে আমলাতান্ত্রিক কারণে আমরা অবসরের কোনো সুযোগ-সুবিধা অদ্যাবধি পাইনি! বলা বাহুল্য, আমাদের প্রচণ্ড দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে অশেষ ধন্যবাদ যে, আমরা জীবনে যত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম, তা আমাদের পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে সম্মানের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত ছিল।

আমি নির্মমভাবে নিহত মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া করি, যিনি সবসময় রক্তপাতের বিরুদ্ধে ছিলেন। আমি কর্নেল হুদা এবং লে. কর্নেল হায়দারের বিদেহী আত্মার জন্যও দোয়া করি, যারা তাদের নেতৃত্বের প্রতি বিরল আনুগত্য দেখিয়েছিলেন। আমি বাংলাদেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী সব মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী জনগণের জন্য দোয়া করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মেজর হাফিজউদ্দিন বীর বিক্রম এবং স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত বীর উত্তমকে খন্দকার মোশতাকের অবৈধ সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা এবং স্বাধীনতার আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করার জন্য ধন্যবাদ জানাই। এ অভিযানে অন্তর্ভুক্ত থাকার জন্য আমার মধ্যে কোনো ধরনের পরিতাপ নেই, বরং আমি গর্বিত এ দলের সদস্য হিসাবে।

কে জানে, ৩ নভেম্বর না ঘটলে বাংলাদেশ এবং তার রাজনীতি কোন খাতে প্রবাহিত হতো! [ফ্লাইট লে. ইকবাল রশীদ (অব.)]

অনুবাদক/লেখকের মূল্যায়ন : ৩ নভেম্বরের এ অভ্যুত্থানের ফলেই খুনি মোশতাক ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মোশতাক ও তার সহযোগীদের অপসারণ করা হয় ক্ষমতা ও বঙ্গভবন থেকে। বলা যেতে পারে, এর মধ্য দিয়ে এ অভ্যুত্থানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সাধিত হয়; যার পেছনে ছিল বিমানবাহিনীর অপরিসীম অবদান।

জাতির সেই ক্রান্তিলগ্নে বিমানবাহিনীর হাতেগোনা কিছু সদস্য দেশের স্বার্থে জীবনবাজি রেখে যে সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন, তা এখন পর্যন্ত লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। সেসব বীরের যথাযথ মূল্যায়ন এবং বীরত্বের স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি। ৩ নভেম্বর বিমানবাহিনীর হাতেগোনা কয়েকজন বৈমানিক, কর্মকর্তা ও বিমান সেনার সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ‘ব্যাটেল ফর ব্রিটেন’ সম্পর্কে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দেয় : ‘Never was so much owed by so many to so few’

নাজমুল আহসান শেখ (অনুবাদক/অনুলেখক) : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.