লোকসানে ডুবছে বিমান

Bimanএভিয়েশন নিউজ: একের পর এক নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ আসছে। বেড়েছে গন্তব্য এবং যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা। তার পরও লোকসানের ধারা থেকে বের হতে পারছে না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের লোকসানই গত অর্থবছরের মোট লোকসানকে ছাড়িয়ে গেছে।

বিমান থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০১২-১৩) লোকসান ছিল ১৯৩ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২২২ কোটি টাকা। বাকি ছয় মাসেও লোকসানের এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বিমানের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলছেন, সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার অভাব এবং দুর্নীতি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে অনেকগুলো জ্বালানিসাশ্রয়ী উড়োজাহাজ এনেও লোকসান সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

অথচ বিমানকে লাভজনক করার লক্ষ্যে গত বছরের মার্চে উচ্চ বেতনে যুক্তরাজ্যের নাগরিক কেভিন স্টিলকে (৬৩) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেন, দুই বছরের মধ্যে বিমান লাভে যাবে। চলতি অর্থবছরে লাভ-লোকসান সমান সমান বা খুবই কম লোকসান হবে। পরের বছর লাভে যাবে। কিন্তু এক বছরের মাথায় বিমানকে লোকসানের পুরোনো ধারায় রেখে তিনি পদত্যাগ করলেন। গতকাল শনিবার তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। বিমানের ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পেয়েছেন পরিচালক (যাত্রীসেবা) এ এম মোসাদ্দিক হোসেন। তিনি এর আগেও কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত ছিলেন।

বিমানের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিমান বহরে ছয়টি বোয়িং ৭৭৭ যুক্ত হওয়ার পর চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই ’১৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ’১৪) বিমানের যাত্রী পরিবহনক্ষমতা কমে গেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরের ওই আট মাসে বিমান যাত্রী পরিবহন করে ১১ লাখ ৭৭ হাজার। আর, চলতি অর্থবছরে একই সময়ে এ সংখ্যা কমে হয়েছে সাড়ে নয় লাখ।
এ ছাড়া, গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে টিকিট বিক্রি থেকে বিমানের রাজস্ব আয় হয়েছিল দুই হাজার ২৮২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে অঙ্কটা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৮৬৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। রাজস্ব আয় কমেছে ৪১৪ কোটি টাকা। অথচ এ সময়ে এ খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই হাজার ৬১০ কোটি টাকা।

বিমান হিসাব শাখা থেকে জানা যায়, ১৯৯০ সালের পর বিমানের লোকসানের প্রবণতা বেড়েছে। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে গত ১৮ বছরে বিমান লাভের মুখ দেখেছে মাত্র চার বছর। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে লাভ করেছিল বিমান। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিমানের সাবেক প্রধান জামাল উদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান করে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। এরপর আবার লোকসানে যায় বিমান। গত চার অর্থবছরে যথাক্রমে ৪৬ কোটি, ১৯৯ কোটি, ৬০৫ ও ১৯৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, এখন বিমান বহরে আধুনিক উড়োজাহাজ যেমন বেড়েছে, এর গন্তব্যের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই বিমানের লোকসান বাড়ার কথা নয়, বরং আগের চেয়ে কমে আসার কথা। এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি আজ বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসবেন বলে জানান।

সর্বত্র পরিকল্পনাহীনতা: দুই দশক ধরে বিমানের কর্তাব্যক্তিরা বলে আসছিলেন, উড়োজাহাজ সংকট ও বহরে থাকা দীর্ঘদিনের পুরোনো উড়োজাহাজের অতিরিক্ত জ্বালানি খরচের কারণে লোকসান হচ্ছে। কিন্তু এখন পুরোনো উড়োজাহাজ (ডিসি-১০ ও এফ-২৮) বাদ দেওয়া হয়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ রয়েছে বহরে। গত বছর বিমান প্রায় ১৬ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে। চলতি বছর এসে যাত্রী পরিবহনক্ষমতা বেড়েছে আরও প্রায় পাঁচ লাখ।

তার পরও কেন লোকসান দিতে হচ্ছে? বিমানের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, এতগুলো আধুনিক উড়োজাহাজের যথোপযুক্ত ব্যবহার, এর জন্য বৈমানিকসহ ক্রু পরিকল্পনা কী হবে এবং প্রতিযোগিতার বাজারে যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে কী ধরনের বিপণন কার্যক্রম চালানো হবে, এসবের জন্য কার্যকর কোনো পরিকল্পনা বিমান নিতে পারেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের একজন পরিচালক বলেন, এখন বহরে নতুন কেনা চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর, মিসর থেকে ভাড়া করা দুটি ৭৭৭-২০০ইআর, দুটি এয়ারবাস-৩১০, দুটি বোয়িং ৭৩৭সহ আটটি সুপরিসর আধুনিক উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে বোয়িং ৭৭৭ অনেক দূরপাল্লার গন্তব্যে বিরতিহীন ফ্লাইট পরিচালনার উপযোগী। এসব উড়োজাহাজ দিয়ে কম দূরত্বে ফ্লাইট পরিচালনা করে পোষাবে না। ওই কর্মকর্তার মতে, মিসর থেকে বাড়তি দুটি বোয়িং ৭৭৭ ভাড়া না করে মাঝারি আকারের কয়েকটি উড়োজাহাজ বেশি দরকার ছিল। কারণ, কলকাতা, দিল্লি, কাঠমান্ডু, ইয়াঙ্গুন, ব্যাংকক, হংকং, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুরের মতো অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের গন্তব্যে মাঝারি আকারের উড়োজাহাজ প্রয়োজন। তা ছাড়া, এ ধরনের দূরত্বের মধ্যে শিগগিরই শ্রীলঙ্কার কলম্বো, মালদ্বীপের মালে ও চীনের গুয়াংঝুতে ফ্লাইট চালুর কথা বলছে বিমান।

বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন, বিমান মন্ত্রণালয়ের এমন একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি জানান, বোয়িং কোম্পানি একটি বাণিজ্যিক পরিকল্পনা করে দিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা আর অনুসরণ করা হয়নি। কোন বিবেচনায় হংকং ফ্লাইট চালু করা হলো, তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। কারণ, বাংলাদেশ থেকে হংকংয়ের ভিসা পাওয়া কঠিন ব্যাপার। এখানে তাদের কোনো ভিসা কেন্দ্র নেই। ড্রাগন এয়ারের টিকিট কিনলে তারা পাসপোর্টসহ কাগজপত্র হংকং পাঠিয়ে ভিসার ব্যবস্থা করে দেয়। এই অবস্থায় বিমান কীভাবে

গন্তব্যে যাত্রী পাবে?
ওই কর্মকর্তা বলেন, পাঁচ-ছয় বছর আগে কাতার এয়ারওয়েজ যখন ঢাকা-দোহা ফ্লাইট শুরু করে, তখন তাদের সপ্তাহে তিন দিন ফ্লাইট ছিল। এখন তারা প্রতিদিন দুটি ফ্লাইট চালায়। আর বিমানের রয়েছে সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট। এ গন্তব্যে বাংলাদেশি শ্রমিকেরাই মূল যাত্রী। তাঁরা বাংলাদেশ বিমানে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু লাভজনক এ গন্তব্যে ফ্লাইট সংখ্যা না বাড়িয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ হংকংয়ের মতো লোকসানি গন্তব্যে ফ্লাইট চালু করেছে।

বিমানের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বোয়িং ৭৭৭ চালানোর মতো এখন বিমানের উপযোগী গন্তব্য রয়েছে লন্ডন, রোম ও ফ্রাঙ্কফুর্ট। প্রথমত, এ কয়টির জন্য এতগুলো উড়োজাহাজ দরকার পড়ছে না। আবার ইউরোপের গন্তব্যে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ দিয়ে পরিচালিত ফ্লাইটে যাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য কোনো তৎপরতা নেই। বর্তমানে ঢাকা-লন্ডন গন্তব্যে একমাত্র বিরতিহীন সরাসরি ফ্লাইট আছে বাংলাদেশ বিমানের, তা-ও নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ দিয়ে পরিচালিত। কিন্তু বিমান যাত্রীসেবার মান ঠিক রাখতে না পারায় অভিজাত শ্রেণীর (বিজনেস ক্লাস) যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। অথচ বিজনেস ক্লাস পুরো জাহাজের চার ভাগের এক ভাগ জায়গা নেয় আর রাজস্ব দেয় তিন ভাগের দুই ভাগ।

দীর্ঘদিন লোকসানের কারণে ২০০৬ সালে বিমান কর্তৃপক্ষ জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট, জাপানের নারিতা, যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারসহ আটটি গন্তব্যে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। এসব ফ্লাইট আবার চালু করা হচ্ছে ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই। ফ্রাঙ্কফুর্ট ফ্লাইট চালু করা হয় গত ৩১ মার্চ। ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েও ৪১৯ আসনের উড়োজাহাজের প্রথম ফ্লাইটে বিক্রি হয় মাত্র ২৯টি টিকিট। আর ফিরতি ফ্লাইটে টিকিট বিক্রি হয় ৫৯টি। ৪ এপ্রিল দ্বিতীয় ফ্লাইটে মাত্র ১৬ জন যাত্রী ছিল। একইভাবে সদ্য চালু করা ইয়াঙ্গুন, দিল্লি, ম্যানচেস্টার ফ্লাইটেও পর্যাপ্ত যাত্রী নেই।

জানতে চাইলে বিমানের পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও রোমে প্রত্যাশিত যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না ঠিক; তবে লন্ডন, জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম ও কুয়ালালামপুর গন্তব্যে বেশ যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লাইয়ারস, অনলাইনে টিকিট বিক্রিসহ কিছু কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। আগামী মে মাসে আরও কিছু সফটওয়্যার চালু ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচারের উদ্যোগসহ কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। জুলাই-আগস্ট নাগাদ তার ফল পাওয়া যাবে। এদিকে নিউইয়র্ক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আরও দুটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ বিদেশি বৈমানিক, বিমা ও রক্ষণাবেক্ষণসহ (ওয়েট লিজ) ভাড়া করার প্রক্রিয়া চলছে। এ ক্ষেত্রেও ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি বলে জানা গেছে।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালে ১০টি নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ কেনার জন্য মার্কিন বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বিমান। চুক্তি অনুযায়ী, এরই মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭ এসেছে। আগামী বছরের শেষের দিকে বিমানের বহরে যুক্ত হবে দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০। এ ছাড়া, চারটি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিমান বহরে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এসব উড়োজাহাজের কোনটি কোন গন্তব্যে ব্যবহার করা হবে, তার জনবলকাঠামো বা পরিকল্পনা কী হবে, তারও কোনো কর্মপরিকল্পনার কথা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানাতে পারেননি।

বৈমানিকদের নিয়ে আত্মঘাতী কারসাজি:
বিমানের দাপ্তরিক তথ্য অনুযায়ী, বিমানে এমনিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বৈমানিক নেই। নতুন চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর আসার পর বৈমানিকের চাহিদা ও সংকট আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটির জন্য সাত সেট করে বর্তমানে বহরের ছয়টি বোয়িং ৭৭৭-এর জন্য অন্তত ৪২ সেট বৈমানিক দরকার। একজন ক্যাপ্টেন ও একজন কো-পাইলট বা ফার্স্ট অফিসার মিলে একটি সেট। অর্থাৎ ছয়টি বোয়িং-৭৭৭-এর জন্য ৮৪ জন বৈমানিক দরকার। অবশ্য বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখার রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটির জন্য ছয় সেট ধরে এখন মোট ৩৬ সেট বা ৭২ জন বৈমানিক দরকার। কিন্তু আছেন মাত্র ৪৭ জন। সামনে আরও উড়োজাহাজ আসবে। চাহিদাও বাড়বে।

ফ্লাইট পরিচালন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন উড়োজাহাজ কখন কোনটা আসবে, সেটা ২০০৮ সালেই নির্ধারিত। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাওয়ার পর নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আগে থেকে এ জন্য যথাযথ ক্রু পরিকল্পনা করতে পারেনি। বিমানে নানা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়ে গত পাঁচ থেকে সাত বছরে অন্তত ৩০ জন বাংলাদেশি বৈমানিক কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসসহ বিভিন্ন বিদেশি বিমান সংস্থায় চলে গেছেন।

বাংলাদেশ সরকার অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করেছে। আর শ্রম আইন অনুযায়ী, বৈমানিকদের বয়সসীমা ৬০ বছর করা হয়েছে। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ তা মানছে না। অথচ আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ অনেক আগে বৈমানিকদের চাকরির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৫ বছর করেছে। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই এই বয়সসীমা কার্যকর করা হয়েছে। বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বৈমানিকদের ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিমান কর্তৃপক্ষ তার নিজেদের অভিজ্ঞ বৈমানিকদের ৫৭ বছর বয়সে অবসরে পাঠাচ্ছে। আবার তাঁদের চেয়ে বেশি বয়সের, ৬২-৬৩ বছরের বিদেশি পাইলট আনছে দ্বিগুণ বেতন ও সুবিধা দিয়ে। বিদেশি বৈমানিকদের মূল বেতন মাসে ১২ হাজার মার্কিন ডলার (আয়করমুক্ত)। পাঁচ তারকা হোটেলে থাকাসহ সব সুবিধা ধরলে একেকজন বিদেশি পাইলটের পেছনে মাসে খরচ দাঁড়ায় ১৮ হাজার মার্কিন ডলারের (১৪ লাখ টাকা) বেশি। অপরদিকে দেশি বৈমানিকদের সবকিছু মিলিয়ে বেতন দাঁড়ায় নয় হাজার ২০০ ডলার। বিদেশিদের চার সপ্তাহ কাজের পর দুই সপ্তাহ ছুটি। অর্থাৎ তিন মাসে ছুটি দাঁড়ায় এক মাস। আর, একই বিমানের দেশি পাইলটরা এক মাস কাজ করে আট দিন ছুটি পাওয়ার কথা থাকলেও ছুটি পান চার দিন।

জানতে চাইলে ফ্লাইট পরিচালন শাখার পরিচালক ক্যাপ্টেন ইশরাত হোসেন বলেন, বোয়িং ৭৭৭-এর বৈমানিক সংকট আছে। আপাতত সংকট সামাল দিতে এখন চারজন বিদেশি বৈমানিক আনা হয়েছে। আরও আটজন শিগগিরই আনা হবে। বাংলাদেশিদের অবসরের বয়সসীমা না বাড়িয়ে কেন বিদেশি পাইলটদের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন, এ প্রশ্নের জবাবে ক্যাপ্টেন ইশরাত বলেন, বিমানে নিজস্ব বৈমানিকদের চাকরি চলে বিমানের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি অনুযায়ী। তাই সরকারি আইন অনুযায়ী বয়স বাড়ানো হয়নি। তিনি দাবি করেন, দেশি অভিজ্ঞ বৈমানিকদেরও চুক্তিভিত্তিক দেশীয় দরে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বাস্তবে সবার ক্ষেত্রে এটা পুরোপুরি সত্য নয়। সম্প্রতি অবসরে যাওয়া বোয়িং ৭৭৭-এর একাধিক দেশি বৈমানিককে সাত হাজার ডলার বেতনে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আবার আয়কর কাটা যাবে এক হাজার ২০০ ডলার। এতে তাঁরা সম্মত হননি। কম বেতন প্রস্তাব করে দেশি বৈমানিকদের নিরুৎসাহিত করার নেপথ্যে বিদেশিদের কাছ থেকে ‘কমিশন-বাণিজ্যের’ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে বিদেশি বৈমানিক আনার ক্ষেত্রে তাঁদের বিষয়ে নিজ নিজ দেশের পুলিশের প্রতিবেদন, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষাসহ অনেক দরকারি বিষয় দেখা হচ্ছে না। সম্প্রতি মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের নিখোঁজের ঘটনার পর এ বিষয়টি বেশ সামনে এসেছে।

জানা গেছে, বোয়িং ৭৭৭-এ একেকজন বৈমানিকের পেছনে শুধু প্রশিক্ষণ বাবদ বিমানের খরচ হয় ৭০ লাখ টাকার মতো। তাঁদের অনেককে দেড় বছর চাকরি করতে না-করতেই অবসরে পাঠানো হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ রকম ১২ জনকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। চলতি বছর আরও চারজন অবসরে যাবেন।

এ রকম সম্প্রতি অবসরে যাওয়া জ্যেষ্ঠ বৈমানিক ক্যাপ্টেন এস এম হেলাল বলেন, বিদেশ থেকে বেশি বেতনে তাঁদের চেয়ে বেশি বয়সীদের আনা হচ্ছে। আর, তাঁরা এ দেশের নাগরিক হয়েও এবং দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কেন সংবিধান অনুযায়ী বৈধ সুযোগ পাবেন না, সেটা বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, অথচ বিমান কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে চাকরির বয়স ৬২ বছর করে প্রশাসনিক আদেশ জারি করেছিল। কিন্তু তাতে বাপার (পাইলট অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী অনেক সুবিধা বাদ দেওয়া হয়েছিল। সেটা বৈমানিকদের জন্য অপমানজনক বলে তখন তাঁরা আন্দোলন করেন এবং প্রশাসনিক সালিসি ট্রাইব্যুনালে যান। তাতে বৈমানিকদের পক্ষে রায় এলে বিমান কর্তৃপক্ষ নিম্ন আদালতে আপিল করে। তার পরও বিমান কর্তৃপক্ষ চাইলে এখনো সরকারি আইন অনুযায়ী অথবা সিভিল এভিয়েশনের লাইসেন্সের বয়স অনুযায়ী চাকরির বয়স ৬০ বা ৬৫ করতে কোনো বাধা নেই বলে দাবি বৈমানিকদের।

– টিপু সুলতান, দৈনিক প্রথম আলো

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.