দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর সেবার মান বাড়ছে না

নিয়ন্ত্রক ও সেবা সংস্থা একই সঙ্গে হওয়ার এই বিপত্তি

নিয়ন্ত্রক ও সেবা সংস্থা একই সঙ্গে হওয়ার কারণে দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর সেবার মান বাড়ছে না। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণে বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তার মানও তলানিতে পড়ে আছে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে আলাদা নিয়ন্ত্রণকারী ও সেবা কর্র্তৃপক্ষ গঠন করতে চায় সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি)।

কিন্তু দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শেষে কবে নাগাদ এসব কর্র্তৃপক্ষ গঠন করা যাবে, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। সিএএবির চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান  বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশন (আইকাও) চায় আলাদা কর্র্তৃপক্ষ করা হোক। তাদের মতে, নিয়ন্ত্রক আর সেবা প্রদানকারী কর্র্তৃপক্ষ এক হতে পারবে না। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি সরকারকে জানাব।’ খবর : দেশ রূপান্তর, ১৭ জুলাই ২০২০।

আইকাওর পাশাপাশি সিএএবির কাজকে আরও গতিশীল করতে নিয়ন্ত্রক ও সেবা সংস্থাকে আলাদা করার সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তারা বলেছে, সিভিল এভিয়েশনের রেগুলেটরি কাজ ও বিভিন্ন বিমানবন্দরের সার্ভিস প্রোভাইডারের কাজ আলাদা করে ভিন্ন সংস্থা করা দরকার, যাতে বিমানবন্দরগুলো স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে।

গত মাসে সিএএবি পরিচালনা পর্ষদ সভায় আলাদা কর্র্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে একটি কমিটি গঠন করে তাদের দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিএএবি চেয়ারম্যান। পর্ষদ সভায় উপস্থিত এক সদস্য  বলেন, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি একই সঙ্গে রেগুলেটরি কর্র্তৃপক্ষ, এয়ারপোর্ট অপারেটর ও এয়ার নেভিগেশন সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে কাজ করছে।

একই সঙ্গে রেগুলেটরি সংস্থা ও সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ ছাড়াও সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সুরক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে কর্র্তৃপক্ষকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আইকাও বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দিয়েছে তারা। আইকাও অডিট আপত্তি দিয়েছে। এ ধরনের আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। পরে অডিট আপত্তি ধরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে আইকাও।

পরিচালনা পর্ষদের এক সদস্য বলেন, আইকাওভুক্ত অধিকাংশ দেশেই বেসামরিক বিমান চলাচল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বতন্ত্র সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব সংস্থা সার্ভিস প্রোভাইডার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং জাপানও সিভিল এভিয়েশন ও সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে আলাদা সংস্থা গঠন করেছে। আইকাওভুক্ত অন্যান্য দেশও রেগুলেটরি বডি ও সার্ভিস প্রোভাইডারকে আলাদা করার কাজ শুরু করেছে।

দেশেও অনেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে যেগুলো সেবাদানকারী সংস্থা থেকে ভিন্ন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষ বা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সরকারের স্থলপথে চলাচলকারী যানবাহনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। বিআরটিসির পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানায়ও সড়কপথে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সরকারের টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আর টেলিটক হচ্ছে সেবা প্রদানকারী সংস্থা।

একই সঙ্গে দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মোবাইল ফোন পরিচালনাকারী সংস্থা গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও এয়ারটেল টেলিযোগাযোগ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা; যা সব রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত ব্যাংকের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাজও তারা তদারকি করে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সরকারের জ¦ালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা; যা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ডেসকো, তিতাস ও বাখরাবাদের কাজ তদারকি করে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্র্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সরকারের নৌপথে চলাচলকারী নৌযানের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা; যা সরকারের নিজস্ব নৌযান ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) যাত্রী সেবা দিয়ে থাকে।

সার্বিক দিক বিবেচনা করে সিএএবি নিয়ন্ত্রক ও সেবাদানকারী হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা গঠনের জন্য আইকাওর সহযোগিতা চেয়েছে বলে জানা গেছে। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি স্টাডি করে প্রতিবেদনও দিয়েছে জানিয়ে সিএএবির কর্মকর্তারা বলেন, সরকারি ও বেসরকারি বিমান চলাচলের নিয়ন্ত্রণ এবং বিমান চলাচলসংক্রান্ত সেবা প্রদানের জন্য এয়ারপোর্ট অপারেটর, এয়ার নেভিগেশন সার্ভিস, এয়ার ট্রাফিক সার্ভিস, কমিউনিকেশন সার্ভিস, সিকিউরিটি সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবার সুষ্ঠু ও নিরাপদ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা রেগুলেটরি সংস্থা থাকা দরকার। এ ছাড়া আইকাওর চাহিদা মেটাতে এবং এভিয়েশনের সঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে নিয়ন্ত্রক ও সেবা সংস্থাকে আলাদা করা দরকার।

তারা আরও বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিদ্যমান সাংগঠনিক এবং আর্থিক অবকাঠামোর মধ্যেই রেগুলেটরি ও সার্ভিস প্রোভাইডার আলাদা করার কাজ দুই ধাপে করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে সিভিল এভিয়েশন অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে রেগুলেটরি সংস্থাকে আর্থিক এবং কার্যক্রমের দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা এবং সার্ভিস বডিকে একত্র করা যায়। রেগুলেটরি বডির সমন্বয়ে অথরিটি সংস্থার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে সার্ভিস প্রোভাইডার বডির সমন্বয়েও একটি আলাদা সংস্থা সৃষ্টি করা যেতে পারে।

প্রকাশ : দেশ রূপান্তর, ১৭ জুলাই ২০২০

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.