বাড়তি দামেও মিলছে না বিমানের টিকিট

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অফিসে টিকিট নিয়ে হাহাকার

মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীদের বিমান টিকিট নিয়ে হাহাকার চলছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলো চালুর পর থেকেই এই অবস্থা চলছে। বিমানের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অফিসে টিকিট প্রত্যাশীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ উঠেছে, যাত্রীরা বিমান অফিসে গিয়ে টিকিট না পেলেও দালালদের মোটা অঙ্কের টাকা দিলে মিলছে টিকিট। কয়েক দিন ধরে ৩৮ হাজার টাকার টিকিট বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিতে বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়।

জানা গেছে, যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাদের অনেকে দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ দামে টিকিট কিনে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। এই সুযোগে একটি সিন্ডিকেট বাড়িয়ে দিচ্ছে টিকিটের দাম। এদের সঙ্গে বিমানের মার্কেটিং বিভাগের একটি অসাদু চক্র জড়িত। কোনো যাত্রী টিকিটের জন্য বিমানের অফিসগুলোয় গেলে তাকে বলা হচ্ছে টিকিট নেই। একই সঙ্গে তারা জানিয়ে দিচ্ছে কোন এজেন্সির কাছে কোন এয়ারলাইন্সের টিকিট পাওয়া যাবে। এ অবস্থায় অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে ওইসব স্থানে গিয়ে চড়া দামে টিকিট কিনছে।

বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বাভাবিকের তুলনায় ফ্লাইট সংখ্যা এখন অনেক কম। কিন্তু টিকিটের চাহিদা অনেক। এতে চরম বিপাকে চট্টগ্রামের প্রবাসীরা। কাঠখড় পুড়িয়েও মিলছে না টিকিট। এই সুযোগে দুই থেকে তিনগুণ টিকিটের বাড়তি দাম রাখছে বিমান সংস্থাগুলো। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইন যাওয়ার জন্য ৪০ হাজার টাকার টিকিট ১ লাখ ৪০ হাজারেও মিলছে না। একইভাবে অন্যান্য গন্তব্যের বিমান টিকিটের দামও চড়া। তাদের অভিযোগ- ‘আগে যেসব রুটের টিকিটের দাম ৬০ হাজার টাকা, এখন সেটি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।’ রোববার বিমানের মতিঝিল, ফার্মগেট ধানমণ্ডি ও হজ ক্যাম্প কার্যালয়ে ছিল টিকিট প্রত্যাশীদের উপচে পড়া ভিড়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেট অফিসেও টিকিটের জন্য চলছে হাহাকার।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন  বলেন, এ মুহূর্তে ২ হাজার যাত্রীকে টিকিট দেয়া নিয়ে তিনি বেশি চিন্তিত। কারণ এই টিকিটগুলো আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব যাত্রী যেতে পারেননি। এখন তাদের আগে টিকিট দিতে হচ্ছে। যেহেতেু আগের যাত্রীরা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন, এ কারণে নতুন যাত্রীরা টিকিট পাচ্ছেন না। এ কারণে টিকিটের জন্য হাহাকার শুরু হয়ে গেছে।

রোববার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতেও বলা হয়েছে, দুবাই ও আবুধাবি রুটে মহামারীর আগে যাদের টিকিট কেনা ছিল, এখন তাদের টিকিট দেয়া হচ্ছে বলে নতুন টিকিট প্রত্যাশীরা তা শুরুতে পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ বিমানের টিকিট না পেয়ে চট্টগ্রামে ভাংচুরের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, ঢাকা-দুবাই ও ঢাকা-আবুধাবি রুটে যেসব যাত্রী আগে ফিরতি টিকিট করার পরও করোনার কারণে তখন যেতে পারেননি, আগে তাদের টিকিট দেয়া হবে। ফিরতি টিকিট রি-ইস্যু সম্পন্ন হওয়ার পরই কেবল নতুন করে টিকিট বিক্রি শুরু করা হবে।

চট্টগ্রামে বিমানের কাউন্টারে নয়, চড়াদামে টিকিট মিলছে এজেন্সিতে : চট্টগ্রামে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকিট নিয়ে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। টিকিটের জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে নগরীর ষোলশহর ২ নম্বর গেটে বিমান অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন হাজার হাজার বিদেশগামী যাত্রী। প্রতিদিন হাতেগোনা কয়েকজন টিকিট পেলেও অধিকাংশই ফিরছেন খালি হাতে। অভিযোগ আছে, চট্টগ্রামে বিমানের টিকিট নিজস্ব কাউন্টারে নয়; মিলছে বিভিন্ন এজেন্সির কাছে। চড়া দামে।

টিকিটবঞ্চিতদের এজেন্সিতে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বয়ং বিমান অফিসের কাউন্টারে কর্মরত লোকজন। এ কারণে রোববার সকালে বিমান অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেন হয়রানির শিকার যাত্রীরা। চট্টগ্রাম থেকে এখনও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ফ্লাইট চালু হয়নি। ঢাকা হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের প্রবাসীরা।

করোনা মহামারীর কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও আবুধাবি থেকে আসা ২৫ থেকে ৩০ হাজার প্রবাসী আটকা পড়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রামে। এর মধ্যে যারা দেশে ৬ মাস অতিক্রান্ত করেছেন, তারা নানা সংকটে পড়েছেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে দুবাই ও আবুধাবির ফ্লাইট চালুর পর থেকে বিমান অফিসে প্রবাসীদের ভিড় বেড়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম তথা তিন পার্বত্য জেলা এবং ফেনী থেকেও টিকিটের জন্য বিদেশগমনেচ্ছুরা আসছেন চট্টগ্রামে বিমান অফিসে। দুবাই ও আবুধাবির প্রবাসীরা যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের ‘অ্যাপ্রোভাল’ (অনুমোদন) ছাড়া টিকিট দেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোববার সকাল থেকে টিকিট প্রত্যাশীদের ব্যাপক ভিড় লক্ষ করা গেছে। ষোলশহর দুই নম্বর গেটে অবস্থিত বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের অফিসে টিকিট প্রত্যাশীদের লাইন কাউন্টার ছাড়িয়ে অফিসের বাইরে ফুটপাত ও রাস্তা পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। বৃষ্টিতে ভিজে এবং রোধে পুড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিকিটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাদের। দীর্ঘ লাইন সামলাতে হিমশিম খেতে হয় বিমান অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের। এ কারণে স্থানীয় পাঁচলাইশ থানা পুলিশকে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হয়।

পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, ‘বিমান অফিসে টিকিট প্রত্যাশীদের ভিড় সামাল দিতে প্রতিদিন এক প্লাটুন পুলিশ পাঠানো হচ্ছে। বিমান অফিসের কর্মকর্তাদের অনুরোধে পুলিশ এ দায়িত্ব পালন করছে।’

বিমান অফিসে টিকিট কাটতে আসা নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছি। ভেতরে কাউন্টারে গিয়ে দেখি ২৫ ও ২৬ আগস্টের দুবাইগামী বিমানের সিট নেই। কাউন্টারের লোকজন এজেন্সিতে যোগাযোগ করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে।

রাউজান পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা মো. তসলিম উদ্দিন জানান, ‘আমি করোনা পরিস্থিতির আগে দেশে বেড়াতে এসেছি। এখন ৯ মাস হয়েছে। ফ্লাইট চালুর পর থেকে দুবাইয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আসার সময় রিটার্ন টিকিট নিয়ে এসেছি। এতে বাংলাদেশের ৪০ হাজার টাকা খরচ পড়েছে। এখন ফিরতি টিকিট দিয়েও কোনো এজেন্সি ৩৫ হাজার আবার কেউ ৪০ হাজার টাকা দাবি করছে।

এর আগে আমার এক পরিচিত ব্যক্তি ফিরতি টিকিটের সঙ্গে ১১ হাজার টাকা দিয়ে যাওয়ার টিকিট কিনেছেন। আমার অপর এক পরিচিত ব্যক্তি বিমান অফিস থেকে ফিরতি টিকিটে যাওয়া কনফার্ম করেছেন। অথচ টিকিটের প্রকৃত দাম কত বুঝতে পারছি না। সরাসরি বাংলাদেশ বিমান অফিস থেকে টিকিট নেয়ার জন্য পরপর দু’দিন লাইনে দাঁড়িয়েছি। সেখানে কাউন্টারের লোকজন টিকিট নেই বলে জানান।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১১ আগস্ট খবর রটে বিদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ্রোভাল ছাড়া দুবাই ও আবুধাবিতে যাওয়া যাবে। এমন খবরে বিমান অফিসে টিকিটের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিদেশগামী যাত্রীরা। অথচ অ্যাপ্রোভাল ছাড়া যারা গেছেন তাদের পুনরায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে- এমন খবরও টিকিট কাটতে আসা লোকজনের মুখে শোনা যাচ্ছে। তবে চট্টগ্রাম বিমান অফিসে যোগাযোগ করে জানা গেছে, অ্যাপ্রোভাল ছাড়া বর্তমানে কাউকে টিকিট দেয়া হচ্ছে না।

এদিকে নগরীর বেশ কয়েকটি এজেন্সি ঘুরে দেখা গেছে, একেকটি এজেন্সিতে দুবাই ও আবুধাবিগামী বিমানের টিকিটের দাম একেক রকম। যাত্রীদের কাছ থেকে যে যেভাবে পারছে টাকা আদায় করছে। নগরীর চকবাজার এলাকায় অবস্থিত মদিনা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি এজেন্সির ম্যানেজার রায়হান মাহমুদ ফোনে জানান, দুবাই ও আবুধাবির টিকিট আছে। বিজনেস ক্লাসের টিকিটের দাম ১ লাখ ৯ হাজার ৮০০ টাকা করে পড়বে।

তবে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চট্টগ্রাম অফিসের ব্যবস্থাপক মীর আকতারুজ্জামান। তিনি  বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলব না। তবে টিকিটের অবস্থা ভালো। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা থেকে দুবাই ও আবুধাবিতে বিমানের শিডিউল আছে। পরে কখন শিডিউল দেয়া হবে, তা আমার জানা নেই।’

রোববার বিমান মন্ত্রণালয় অপর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা-আবুধাবি-ঢাকা রুটে ৬টি, ঢাকা-দুবাই-ঢাকা রুটে ৭টি, ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা রুটে ১টি, ঢাকা- কুয়ালালামপুর-ঢাকা রুটে ২টি, ঢাকা-গুয়াংজু-ঢাকা রুটে ২টি ও ঢাকা-হংকং-ঢাকা রুটে ২টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

কোভিড-১৯ এর কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। উপরন্তু, দুবাই ও আবুধাবিগামী কোনো ফ্লাইটে ২৪০ জনের বেশি যাত্রী পরিবহন না করার ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনার কারণে বিমানের বোয়িং-৭৭৭ উড়োজাহাজে ৪১৯ জন ও বোয়িং- ৭৮৭-৮ এ ২৭১ জন যাত্রী পরিবহনের সুযোগ থাকলেও তা করা যাচ্ছে না।

এছাড়াও আবুধাবিতে বিমান পরিচালনার জন্য আবুধাবি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সেপ্টেম্বর-২০২০ মাসের শিডিউল এখন পর্যন্ত না দেয়ায় বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-আবুধাবি-ঢাকা রুটে পরিচালিত ফ্লাইটের সেপ্টেম্বরের টিকিট বিক্রি করা যাচ্ছে না। শিডিউল অনুমোদনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব কারণে বর্তমানে ঢাকা-দুবাই ও ঢাকা-আবুধাবি রুটে টিকিটের কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে।

আমাদের সিলেট অফিস জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও আবুধাবির টিকিটের জন্য সিলেটেও চলছে হাহাকার। কিন্তু সেখানেও টিকিট যেন সোনার হরিণ। এই অবস্থায় কারও ভিসার মেয়াদ চলে গেছে। আবার কারও মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। তবুও তারা ফিরে যেতে পারছেন না কর্মস্থল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বা আবুধাবিতে। এ অবস্থায় সিলেটে আটকা পড়া প্রায় ৪ হাজার প্রবাসী চোখে অন্ধকার দেখছেন। কয়েক দিন ধরে ওইসব দেশের যাত্রীরা সিলেটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অফিসের সামনে বিক্ষোভ করছেন।

করোনা পরিস্থিতিতে ফ্লাইট বন্ধ থাকার পর ৪ জুলাই থেকে আবার ফ্লাইট চালু হলে দুবাই ও আবুধাবি প্রবাসীরা সে দেশের সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে ফিরে যাওয়া শুরু করেছেন; কিন্তু টিকিট সংকটের কারণে তারা যেতে পারছেন না। এমনকি অন্যান্য এয়ারলাইন্সের টিকিটও পাওয়া যাচ্ছে না।

সিলেট বিমান অফিসের জেলা ব্যবস্থাপক মো. শাহনেওয়াজ মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ বিমানের টিকিটের সংকট চলছে। ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বিমানের কোনো ফ্লাইটে আসন খালি নেই।

 

-যুগান্তর

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.