থাইল্যান্ডের মুসলিম অধ্যুষিত দক্ষিণের প্রদেশগুলোর উন্নয়নে প্রফেসর ইউনূসের পরামর্শ চাইলো দেশটির সরকার

থাইল্যান্ডের নেতৃস্থানীয় কৃষি বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় কাসেতসার্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণক্রমে নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ২৬-২৮ জানুয়ারী ২০১৯ দেশটির দক্ষিণের বিভিন্ন প্রদেশ পরিদর্শন করেন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণ থাইল্যান্ড দেশটির অন্য অংশগুলোর তুলনায় বিশেষভাবে পিছিয়ে আছে। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে চারটিরই ৮০ শতাংশের বেশী জনগণ মুসলমান। প্রফেসর ইউনূসকে এই এলাকাগুলোর মানুষ ও প্রশাসনের সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে দক্ষিণের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তাঁর পরামর্শের জন্য আমন্ত্রণ জানান হয়।

প্রফেসর ইউনূসকে হাত ইয়াই শহরে স্বাগত জানান “সাউদার্ন বর্ডার প্রভিন্সেস অ্যাডমিনিসট্রেটিভ কেন্দ্র”এর রিয়ার অ্যাডমিরাল  সোমকেআর্ত পোনপ্রায়ুন, যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্রেটারী জেনারেল ও এই পাঁচটি প্রদেশের প্রশাসনিক প্রধান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের একজন স্থায়ী সচিবের মর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তা। এই প্রদেশগুলোতে প্রফেসর ইউনূসের পুরো সফরকালে তিনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। প্রফেসর ইউনূস দক্ষিণের তিনটি প্রদেশ সংখলা, পাট্টানি ও ইয়ালা পরিদর্শন করেন।

তাঁর পরিদর্শনের প্রথম দিনে প্রফেসর ইউনূসকে পাট্টানির কেন্দ্রীয় মসজিদে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান উক্ত মসজিদের ইমাম যাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও পাট্টানির যুব সমাজের প্রতিনিধিরা। গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা মডেল এই অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কীভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে তাঁদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়। উল্লেখ্য যে, খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত পাট্টানি নগরী কয়েক শতক ধরে মালয়েশিয়ান সালতানাতের রাজধানী ছিল।

ঐ দিনই সন্ধায় প্রফেসর ইউনূসের সম্মানে একটি নৈশভোজের আয়োজন করা হয় যেখানে যোগ দেন দক্ষিণাঞ্চলের সেক্রেটারী জেনারেল এবং ইয়ালা, নুরোথায়াই ও পাট্টানির গভর্ণরগণ। তাঁরা এই অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে আঞ্চলিক সরকারের প্রশাসনিক সহায়তা এবং ইউনূস সেন্টারের সাথে কাসেতসার্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও এআইটি ব্যাংকক-এর বিভিন্ন যৌথ কর্মসূচির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। উল্লেখ্য যে, এই তিনটি প্রদেশের সীমানার ওপারেই মালয়েশিয়ায় পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে গভর্ণরগণ আগে থেকেই অবহিত।

তাঁর সফরের দ্বিতীয় দিনে ইয়ালা প্রদেশে আয়োজিত একটি সম্মেলনে প্রদেশটির সকল স্তরের জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন প্রফেসর ইউনূস। সম্মেলন স্থলে পৌঁছালে প্রফেসর ইউনূসকে অভ্যর্থনা জানান প্রদেশটির গভর্ণর এবং ইয়ালা নগরের মেয়র। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণ থাইল্যান্ডের ইয়ালায় নবনির্মিত “ডিপসাউদ গভর্ণমেন্ট কমপ্লেক্স”-এ। প্রফেসর ইউনূসর বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল “টেকসই শান্তির লক্ষ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দিকনির্দেশনা।”

সম্মেলনে যোগ দেন সাউদার্ন বর্ডার প্রভিন্সেস অ্যাডমিনিসট্রেটিভ কমিটির সেক্রেটারী জেনারেল, সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন মহিলা দলের নেত্রী ও ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ বিশেষ করে বিভিন্ন থাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্রী। প্রফেসর ইউনূসের বক্তৃতা শুনতে পাঁচ শতাধিক অংশগ্রহণকারী সম্মেলনে যোগ দেন।

প্রফেসর ইউনূস থাই উপসাগরের তীরে একটি জেলে গ্রাম পরিদর্শন করেন যেখানে তিনি একটি মৎস সমবায়ের সদস্যদের সাথে আলাপ করেন। এই সমবায়ের জেলেরা বিভিন্ন ধরনের মাছ শিকার করেন যা শুকিয়ে ব্যাংকক ও অন্যান্য শহরের বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেলে সরবরাহ করা হয়। সমবায়টির সদস্যরা এ থেকে ভাল দাম পেয়ে থাকেন।  প্রফেসর ইউনূস এ অঞ্চলের জেলে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং তাঁদের আয় ও বিভিন্ন সুযোগ কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে তাঁদের বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে তাঁদের সাথে খোলামেলা আলাপ করেন

দক্ষিণ সীমানা প্রদেশের সরকার এরই মধ্যে দক্ষিণের কমিউনিটিগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে তহবিল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এই লক্ষ্যে কী-কী কর্মসূচি নেয়া যায় সে বিষয়ে তাঁরা প্রফেসর ইউনূসের পরামর্শ চান। প্রফেসর ইউনূস কৃষি পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, রাবার উৎপাদন, মৎস চাষ ও মৎস প্রক্রিয়াজাতকরণ, এবং উৎপাদনকারীদের জন্য সর্বোচ্চ আয় নিশ্চিত করতে এ সকল পণ্য বাজারজাতকরণে সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি ও বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা জয়েন্ট ভেঞ্চার গঠনে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশে নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচির অনুসরণে তরুণ উদ্যোক্তাদেরকে মূলধন সরবরাহ করার লক্ষ্যে সামাজিক ব্যবসা তহবিল গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ইউনূস সেন্টার এবং তার থাই অংশীদার কাসেতসার্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।

২৯ জানুয়ারী ২০১৯ নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ব্যাংককে অবস্থিত থাইল্যান্ডের কৃষি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দেশটির কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী গ্রিসাডা বুনরাকের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

থাই কৃষি মন্ত্রী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রফেসর ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার প্রয়োগ নিয়ে জানতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। মন্ত্রী বলেন যে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রফেসর ইউনূসের সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইছিলেন। থাইল্যান্ডের দক্ষিণে অনগ্রসর পাঁচটি প্রদেশের অবস্থা সরেজমিনে দেখে আসার জন্য তিনি প্রফেসর ইউনূসকে ধন্যবাদ জানান। মন্ত্রী বলেন যে, তিনি পাঁচ বছর ধরে দক্ষিণের প্রদেশ পাট্টানির গভর্ণর ছিলেন এবং দক্ষিণের এই প্রদেশগুলোর মধ্যে তিনি প্রবল সম্ভাবনা দেখতে পান। তিনি সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে দরিদ্র কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের উপায় নিয়ে প্রফেসর ইউনূসের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেন। প্রফেসর ইউনূস বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক কোম্পানীর সাথে সামাজিক ব্যবসা জয়েন্ট ভেঞ্চার নিয়ে আলোচনা করেন। মন্ত্রী সামাজিক ব্যবসার ধারণা ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে তাঁর সহকর্মীদেরকে আরো প্রশিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে কর্মশালার আয়োজন করতে ইউনূস সেন্টারকে অনুরোধ করেন।

থাই কৃষি মন্ত্রীর সাথে বৈঠকে এবং প্রফেসর ইউনূসের দক্ষিণ থাইল্যান্ড সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাসেতসার্র্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধ্যাপক বর্ডিন রাসামিথেস, ব্যাংককে অবস্থিত এআইটি-তে অবস্থিত ইউনূস সেন্টারের ড. ফাইজ শাহ এবং ঢাকায় অবস্থিত ইউনূস সেন্টারের জনাব লামিয়া মোর্শেদ।

প্রফেসর ইউনূস ২৮-২৯ জুন ২০১৯ ব্যাংককে অনুষ্ঠেয় “সামাজিক ব্যবসা দিবস”-এ যোগ দিতে মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন যে, জুনের এই সামাজিক ব্যবসা দিবসে বিশ্ব জুড়ে সামাজিক ব্যবসার উপর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষ করে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সমাধানে কাজ করছেন এমন অনেক বিশেষজ্ঞ সমবেত হবেন।

প্রফেসর ইউনূসকে কাসেটসার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বার্ষিক কৃষি প্রদর্শনী ঘুরিয়ে দেখান হয়। কাসেতসার্র্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে প্রতি বছর তাদের ক্যাম্পাসে এই কৃষি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় এবং থাইল্যান্ডের সকল জেলা থেকে কৃষকরা তাঁদের কৃষিপণ্য এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করে থাকেন।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.