আউটসোর্সিং কোম্পানির পাওনা আটকেছে বাংলাদেশ

passport_new1_211571495আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) সিদ্ধান্ত মেনে নিদির্ষ্ট সময়ের আগে সকল প্রবাসী বাংলাদেশির হাতে এমআরপি পৌঁছে দিতে কয়েকটি আউটিসোর্সিং কোম্পানি নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বিবেচনা করে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাসপোর্ট তৈরির কাজ দেওয়া হয় দু’টি কোম্পানিকে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হতেই চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ না করে চম্পট দিয়েছে কোম্পানি দু’টি। গুটিয়ে ফেলেছে অফিস। ফলে পাসপোর্ট বুঝে পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। এমনকি পাসপোর্ট ফি’র পুরো অর্থও সরকারকে দেয়নি কোম্পানিগুলো। তবে সার্ভিস চার্জ বাবদ সরকারের কাছে মোটা অঙ্কের পাওনা রয়েছে তাদের। এমন অবস্থায় সম্পূর্ণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এসব আউটসোর্সিং কোম্পানির পাওনা আটকে দিয়েছে বাংলাদেশ। চলছে বাকি পাসপোর্ট ফি উদ্ধারের চেষ্টাও।

সংশ্লিষ্ট দূতাবাস, বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

জানা গেছে, দূতাবাসের পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের এমআরপি তৈরির দায়িত্ব পায় ডাটা এজ আই পিপল কনসোর্টিয়াম নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিয়োগ পায় আউটসোর্সিং কোম্পানি আইরিশ করপোরেশন বারহাড।

চুক্তির মেয়াদ শেষ হতেই এসব কোম্পানি নিজেদের অফিস গুটিয়ে ফেলে। অথচ প্রক্রিয়াধীন থাকা পাসপোর্ট আবেদন, বিতরণের অপেক্ষায় থাকা পাসপোর্ট সবই থেকে যায় তাদের কাছে। ফলে একদিকে আবেদনকারীদের নতুন পাসপোর্ট তৈরি কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছিল, অন্যদিকে পাসপোর্ট প্রস্তুত বার্তা পেয়েও নিতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন প্রবাসীরা।

আবার হাজার হাজার পাসপোর্ট ফি’র সমপরিমাণ কোটি কোটি টাকাও এসব সরকারের নির্ধারিত ফান্ডে জমা দেয়নি তারা। এমন পরিস্থিতে বেশ বেকায়দায় পড়ে সরকার।

জানা গেছে, পাসপোর্ট ফি জমা না দেওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি আইরিশের বিরুদ্ধে। মালয়েশিয়ায় নিয়োগকৃত ডাটা এজ বেশিরভাগ পাসপোর্ট ফি জমা দিয়ে নিজেদের পাওনা আদায় করেছে অনেকাংশেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ না করা ও পাসপোর্ট বিতরণ না করা।

পাসপোর্ট অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আবেদনকারীদের কাছ থেকে সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ না করায় প্রায় ২ হাজার লোকের আবেদনের অ্যাপ্রুভাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আউটসোর্সিং কোম্পানিটি বলছে, তারা ডকুমেন্ট মেলাতে পারছে না। কোনো কোনোটা আবার খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না।

ডাটা এজ এ পর্যন্ত মোট ৭০ হাজার পাসপোর্ট এনরোলমেন্ট করিয়েছে। যার মধ্যে পুরো ফি জমা দিয়ে তারা পাসপোর্ট প্রতি ১৮ ডলার হারে ৬০ হাজার পাসপোর্টের সার্ভিস চার্জও সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছে। তবে কোম্পানিটি এখনও ১০ হাজার পাসপোর্টের সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রায় দেড় কোটি টাকা পাবে। যে টাকাটা সেখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশনের হেফাজতে রয়েছে। তবে পাসপোর্ট বিতরণ ও সকল আবেদনের তথ্য মেলাতে না পারা পর্যন্ত সে টাকা তারা তুলতে পারবে না।

বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাসুদ রেজওয়ান বলেন, মালয়েশিয়ায় প্রায় দেড় হাজার পাসপোর্ট প্রবাসীদের মাঝে বিতরণ করা হয়নি। আবার যে আবেদনগুলো প্রক্রিয়াধীন ছিল, সঠিকভাবে তথ্য না নেওয়ায় সেগুলোর অ্যাপ্রুভালও দেওয়া যাচ্ছে না। আমরা সেসব পাসপোর্ট বিতরণ করতে এবং আবেদনগুলোকে অ্যাপ্রুভ করাতে মালয়েশিয়ায় দু’জন কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছি। ডাটা এজকে বলা হয়েছে, এসব কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে।

তিনি বলেন, ‘যেসব আবেদনকারীর পূর্ণ তথ্য তারা (ডাটা এজ) দিতে না পারবে, সেসব আবেদনকারীকে খুঁজে বের করে বাকি তথ্য সংগ্রহ করে এনে আমাদের র্কমর্তাদের কাছ থেকে সেসব আবেদন অ্যাপ্রুভাল করাতে হবে। অথবা আবেদনকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে। এ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের পাওনা অর্থ পাবে না’।

মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত পাসপোর্ট অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, গত ১৫ দিনে জমে থাকা পাসপোর্টের মধ্যে ৬শ’ ৭১টি ইতোমধ্যেই বিতরণ করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলছে। এছাড়া ডাটা এজের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আবেদনগুলোও অ্যাপ্রুভ করার কাজ এগোচ্ছে।

জানা গেছে, আরব আমিরাতে মোট ৪০ হাজার পাসপোর্ট তৈরি করে আইরিশ। যার ফি আদায় হয় প্রায় ১৪ কোটি টাকা। সে টাকার বড় অংশ জমা দিলেও এখনও বাকি প্রায় দুই কোটি টাকা। এছাড়া প্রায় হাজার দেড়েক পাসপোর্ট বিতরণ করেনি আইরিশ। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট প্রতি ১৩ ডলার করে সার্ভিস চার্জ হিসেবে সরকারের কাছে তাদের পাওনা রয়েছে মাত্র সোয়া চার কোটি টাকা। পুরো পাসপোর্ট ফি ও কাজ বুঝে না পাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে কমিশনের কোনো অর্থও ছাড় করা হবে না বলে জানিয়েছে পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মাসুদ রেজওয়ান।

এদিকে সৌদি আরবেও কাজ করেছে একই মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান আইরিশ। সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি পাসপোর্ট তৈরি করেছে আইরিশ। এখানে তারা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার পাসপোর্ট তৈরি করে। শুরুর দিকে পাসপোর্ট ফি’র কিছু টাকা তারা জমা দিলেও শেষের দিকে এসে প্রায় ৫ কোটি টাকা জমা দেয়নি। এদিকে এখানেও সার্ভিস চার্জ হিসেবে পাসপোর্ট প্রতি ৯ ডলার করে সরকারের কাছে আইরিশের পাওনা প্রায় ১২ কোটি টাকার মতো।

সৌদি আরব সূত্র জানায়, জানুয়ারিতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হতেই ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে কোনো ধরনের নোটিশ না দিয়ে হঠাৎ করেই সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে থাকা ছয়টি অফিস বন্ধ করে লাপাত্তা হন আইরিশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ অবস্থায় আইরিশ অফিসে করা পাসপোর্টের আবেদনকারী প্রবাসীরা এমআরপি নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন।

আবার অফলাইনে এনরোলমেন্ট করায় আবেদকারীরা ভুল সিরিয়াল নম্বর পান। যার কারণে পাসপোর্ট অধিদফতরের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কার পাসপোর্ট কোন স্ট্যাটাসে আছে সেটাও জানতে পারছেন না তারা।

এমন পরিস্থিতি সরকারের পক্ষ থেকে আইরিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানানো হয়।

বিদ্যমান পাসপোর্ট সমস্যা মেটাতে মালয়েশিয়ার মতোই দু’টি প্রতিনিধি দল সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঠানো হবে বলেও বাংলানিউজকে জানান মাসুদ রেজওয়ান।

জানা গেছে, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের জন্য আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের (আইকাও) সঙ্গে ১৯৯৮ সালে এমআরপি চুক্তি করে বাংলাদেশ।

আইকাও’য়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১৫ সালের পর নভেম্বরের পর থেকে বিশ্বের যেকোনো দেশে যাতায়াতে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু শুরু থেকেই এমআরপি করার দিকে মনোযোগ দেয়নি সরকার। প্রায় ১২ বছর পর ২০১০ সালে শুরু হয় এমআরপি দেওয়ার প্রকল্প। যে কারণে শেষ দিকে এসে বেশ চাপের মুখে পড়ে সরকার।

পাসপোর্ট অধিদফতর জানায়, এ পর্যন্ত ১ কোটি ৩৫ লাখ এমআরপি প্রিন্ট করানো হয়েছে। তবে প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.