চট্টগ্রাম থেকে নারী শ্রমিকের বিদেশ যাত্রা বেড়েছে

downloadপরিবারের বাধা ও রক্ষণশীলতার বৃত্ত ভেঙে চট্টগ্রাম থেকে বিদেশ যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। সংখ্যায় এটি খুব বেশি না হলেও ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চট্টগ্রামের নারীদের বিদেশ যাওয়ার এই মানসিকতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।

জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের পর থেকে চট্টগ্রাম থেকে নারী জনশক্তি রপ্তানি দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম জেলা থেকে ১ হাজার ৪১১ জন নারী কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮৭৬ জন, ২০১৩ সালে গেছেন ৪২০ জন, ২০১২ সালে ২৮৯ জন এবং ২০১১ সালে ১২২ জন।

ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারী জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ঢাকা জেলা। শীর্ষ পাঁচ জেলার মধ্যে আরও রয়েছে মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী। গত এক দশকে (২০০৫-২০১৫) ঢাকা জেলা থেকে বিদেশ যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। একই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে গেছেন প্রায় চার হাজার নারী শ্রমিক। ২০১৫ সালে সারা দেশ থেকে বিদেশ যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে গেছেন ১ হাজার ৪১১ জন নারী শ্রমিক। গত বছর রপ্তানি হওয়া নারী জনশক্তির মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ গেছে চট্টগ্রাম থেকে। এর আগের বছর এই হার ছিল ১ দশমিক ১৫ শতাংশ, ২০১৩ সালে ছিল দশমিক ৭৪ শতাংশ।
চট্টগ্রাম থেকে নারী শ্রমিকের বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধিকে ইতিবাচক উল্লেখ করে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জহিরুল আলম মজুমদার বলেন, বিদেশে নারীদের কাজ করার বিষয়ে যেসব নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, সেগুলো কাটানোর জন্য সরকার ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। নারীদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে অনেক উন্নয়ন সংস্থাও সহযোগিতা করছে। এর ফলে চট্টগ্রাম থেকে নারী জনশক্তি রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছে।

গত বছর সৌদি আরবে বন্ধ থাকা শ্রমবাজার খুলে দেওয়ার পর ৫৮ হাজারের বেশি শ্রমিক সে দেশে গেছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ২১ হাজার। তবে চট্টগ্রাম থেকে গেছেন মাত্র ৯৩ জন নারী শ্রমিক। গত বছর চট্টগ্রাম থেকে সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে। সংখ্যাটি ৭৪৪ জন। দুবাইয়ে গেছেন ৩৮৫ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম থেকে নারীরা লেবানন, জর্ডান, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও গেছেন। মূলত গৃহকর্মী ও শিশু দেখভালের কাজ করার জন্যই তাঁরা বিদেশে গেছেন।

বাংলাদেশ জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বিদেশে নারী জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে ৬৪ জেলার মধ্যে চট্টগ্রামের অবস্থান ২৭তম। বিপরীতে পুরুষ জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলার অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৫ সালে রপ্তানি হওয়া মোট জনশক্তির প্রায় ৬ শতাংশ গেছে চট্টগ্রাম জেলা থেকে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১। এর মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮। গত বছর রপ্তানি হওয়া মোট শ্রমিকের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশের বেশি।

এক বছর আগে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যাওয়ায় তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েন চট্টগ্রামের ফতেহাবাদের বাসিন্দা জেসমিন আকতার। তাঁর আয়ের কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। তাঁকে সহায়তায় এগিয়ে আসেন ওমান প্রবাসী মামাতো ভাই। ভাইয়ের পরামর্শে গৃহকর্মী হিসেবে ওমানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের নারী কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গত সপ্তাহে কথা হয় জেসমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওমানে তাঁর ভাই যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিকের ছোট বোনের একজন গৃহকর্মী প্রয়োজন। ২০ হাজার টাকা বেতন দেবে। এত টাকা তো দেশে পাব না। সে কারণে সাহস করে সন্তানদের মায়ের কাছে রেখে বিদেশে যাচ্ছি।’

চট্টগ্রামের আনোয়ারা, চন্দনাইশ ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কাজ করছে উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস। কারিতাসের ‘সেফ মাইগ্রেশন’ প্রকল্পের দায়িত্ব কর্মকর্তা শ্যামল মজুমদার বলেন, এই অঞ্চল থেকে পুরুষেরা বিদেশে যেতে যতটা আগ্রহী, নারীরা তার বিপরীত। এর মূল কারণ, রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগও নারীদের বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। এটি কাটাতে পারলে এই অঞ্চলের নারীদের বিদেশযাত্রা অনেক বাড়বে।

সম্প্রতি সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন ফটিকছড়ি জেলার খালেদা আকতার। তিনি বলেন, অনেকেই সৌদি আরব যেতে নিষেধ করছেন। কিন্তু শুনেছি, অনেক মেয়ে এখন কাজ করতে সেখানে যাচ্ছে। নিজে গিয়ে কয়েক মাস পর ছোট ভাইকেও নিয়ে যাব।

চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে নারী কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বর্তমানে ৪০ জন নারী এক মাসের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। গৃহকাজে ব্যবহৃত নানা ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়াও ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। এই কেন্দ্রের অধ্যক্ষ বি এম শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছুটা দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ পাচ্ছেন বিদেশ যেতে ইচ্ছুক নারীরা।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.