শুল্কমুক্ত কোটায় আনা চারটি বিলাসবহুল গাড়ি শর্ত ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার অভিযোগে সেগুলো জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। দুবাইভিত্তিক সাশ্রয়ী বিমান সংস্থা ফ্লাইদুবাইয়ের স্থানীয় এজেন্ট স্কাই এভিয়েশন সার্ভিসেস লিমিটেড এই গাড়িগুলো এনেছিল। অত্যন্ত দামি গাড়িগুলোর শুধু একটিরই শুল্ক সাড়ে ২২ কোটি টাকা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুল তথ্য দিয়ে এই চারটি গাড়ি আনার মাধ্যমে ৩৪ কোটি ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৪ টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত মঙ্গলবার এ তদন্ত প্রতিবেদন এনবিআরের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গাড়ি আনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি শুল্কছাড় পাওয়ারই কথা নয়।
নির্দিষ্ট লভ্যাংশের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ফ্লাইদুবাইয়ের স্থানীয় ব্যবসা পরিচালনা করে স্কাই এভিয়েশন সার্ভিসেস লিমিটেড।
জব্দ চারটি গাড়ির দুটো ল্যান্ড রোভার জিপ, একটি ঘোস্ট ইডব্লিউবি মডেলের রোলস রয়েস কার এবং একটি এস ৫০০ এল মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্জ কার।
বিমানবন্দর ও শুল্ক গোয়েন্দা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমানবন্দরের ভেতরে এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারের কথা বলে আনা হয়েছিল গাড়িগুলো। কিন্তু এগুলো বিমানবন্দরের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল ইসলাম বলেন, তাঁদের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির আদেশটি বাতিল করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্লাইদুবাই ২০১৪ সালে দুটি ল্যান্ড রোভার জিপ এবং ২০১৫ সালে রোলস রয়েস ও মার্সিডিজ বেঞ্জ কার শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করে। নিয়ম অনুযায়ী শুল্ক ও কর পরিশোধ করা হলে ল্যান্ড রোভার ডিসকভারি ফোর এস মডেলের জিপের জন্য শুল্ক হতো ২ কোটি ১৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৮৮ টাকা, ল্যান্ড রোভার স্পোর্ট এসই মডেলের জিপের শুল্ক হতো ২ কোটি ৮৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৭ টাকা। এ ছাড়া রোলস রয়েস ঘোস্ট ইডব্লিউবি মডেলের গাড়ির শুল্ক ২২ কোটি ৫৬ লাখ ৪০ হাজার ১১৩ টাকা এবং মার্সিডিজ বেঞ্জ এস ৫০০ এল মডেলের গাড়ির শুল্ক ৬ কোটি ৫৫ লাখ ৮ হাজার ৭২৫ টাকা হতো। ফলে মোট ৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা শুল্কবঞ্চিত করা হয়েছে এনবিআরকে।
স্কাই এভিয়েশনের চেয়ারম্যান সাইফুল হক বলেন, ‘কাগজপত্রে গাড়িগুলো শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জব্দ করেছে। চাবিগুলোও তারা নিয়ে গেছে। কিন্তু গাড়িগুলো এখনো আমার কাছেই আছে।’ সাইফুলের দাবি, সব ধরনের যাচাই-বাছাই শেষেই এনবিআর গাড়ি আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। সব নিয়ম মেনে বন্দর থেকেও গাড়ি ছাড় করা হয়েছে। কিন্তু এত দিন পর এসে এ নিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আনা গাড়ি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করে সাইফুল হক বলেন, গাড়িগুলো তাঁরা এয়ারলাইনসের কাজেই বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে ব্যবহার করছেন। তা ছাড়া অন্যান্য এয়ারলাইনস এর চেয়েও বেশি দামি গাড়ি আমদানি করেছে।
২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল এনবিআরের অতিরিক্ত সচিব ও সদস্য (শুল্কনীতি) মো. ফরিদ উদ্দিন বিশেষ আদেশ জারি করে শুল্কমুক্তভাবে গাড়ি আমদানির অনুমতি দেন ফ্লাইদুবাইকে। এটা করা হয় বাংলাদেশের সঙ্গে আরব-আমিরাতের ‘এয়ার সার্ভিসেস’ চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী।
প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্লাইদুবাই যে আবেদন করেছিল, সেখানে গাড়ির ব্র্যান্ড, মডেল, ইঞ্জিন নম্বর, চেসিস নম্বর, সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি, তৈরির সাল, প্রস্তুতকারকের মূল্য-সংক্রান্ত সার্টিফিকেট ইত্যাদি তথ্য উল্লেখ করেনি। মৌলিক এসব তথ্য পরিহার করে আমদানিকারক সুকৌশলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে গাড়ি আমদানির অনুমতি পান।
অন্যদিকে ফ্লাইদুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এয়ার সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্টের অনুচ্ছেদ ৬-এ গাড়ি বা অনুরূপ দীর্ঘস্থায়ী জিনিস আনার কোনো সুযোগও রাখা হয়নি। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুল্ক সুবিধার আওতায় রয়েছে যাত্রী পরিবহনকালে বিমানে অবস্থানকারী যাত্রীদের সেবা দেওয়ার জন্য খাদ্যদ্রব্য, লিকার, বেভারেজ ও সিগারেট। এ ছাড়া স্টাফ ইউনিফর্ম, কম্পিউটার, ডিসপ্লে ইউনিট, টিকিট, লাইন প্রিন্টার ইত্যাদি সরবরাহ এবং এয়ারক্রাফট স্টোরস, স্পেয়ার পার্টস, জ্বালানি ও লুব্রিকেন্ট শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় রয়েছে।
এমনকি ২০১০ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জারি করা এয়ার সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্টের আওতায় কর মওকুফের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানেও শুল্কমুক্তভাবে গাড়ি আমদানির সুযোগ রাখা হয়নি।
এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তির যে ধারার সুযোগ নিয়ে গাড়ি আমদানি করা হয়েছে, সেই ধারায় শুল্কমুক্তভাবে গাড়ি আমদানির সুযোগ নেই। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।