ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাতের নামে চলছে লাখো টাকার বাণিজ্য। বিশেষ ব্যবস্থায় সাক্ষাতের নামে বন্দীর স্বজনদের কাছে প্রকাশ্যে বিভিন্ন ধরনের কুপন বিক্রি হচ্ছে। ১০০, ২০০ ও ৯০০ টাকায় তিন ধরনের কুপন বিক্রি করা হলেও, কুপনের কোথাও লেখা থাকে না টাকার অঙ্ক।
কারা সদস্যদের অবশ্য দাবি, সাক্ষাতপ্রার্থী স্বজনদের বিনামূল্যে কুপন দেয়া হয়। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিনামূল্যের সীমিত কিছু কুপন দেয়া হয় বটে, কিন্তু সেই কুপন নিয়ে সাক্ষাত কক্ষে গিয়ে বন্দীদের দেখা মেলে না। হাতে নগদ টাকা গুঁজে দেয়া না পর্যন্ত আসামিকে ডেকে দেয় না কারারক্ষীরা।
সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় কারা ফটকের অদূরে চকবাজারগামী রাস্তার পূর্বদিকে বন্দী স্বজনের সাক্ষাতপ্রার্থী শত শত নারী-পুরুষ কড়া রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। সাক্ষাতপ্রার্থীদের মধ্যে শিশুরাও ছিল।
কারা ক্যান্টিনের সামনে দু’জন কারাসদস্যের একজন ১০০ টাকা মূল্যের ও অপরজন ২০০ টাকা মূল্যের বিশেষ কুপন বিক্রি করছিলেন। কারাগারের ভেতরে স্বজনদের জন্য খাবার পাঠাতে ক্যান্টিনে কেউ রুটি, বিস্কিট, কেক, সিগারেট, কেউ আবার কমলা, আপেল, তরমুজ, কলা কিনছিলেন।
কারাসদস্যদের সামনে দিয়ে অপরিচিত কেউ গেলেই তাকে ডেকে আসামি রয়েছে কি না জানতে চাওয়া হয়। বিশেষ কুপনে বিশেষ ব্যবস্থায় সাক্ষাত করিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে চলে কুপন বিক্রির চেষ্টা।
সানাড়পাড় থেকে এক পরিবারের ছয়জন দেখা করতে গিয়েছিলেন। রাসেল নামে ওই পরিবারের এক যুবক বলেন, তার বড়ভাইকে ‘শত্রুতা করে’ ইয়াবাসহ ধরিয়ে দিয়েছেন মহল্লার একজন দুষ্টু মানুষ। ডেমরা থানায় ছাড়িয়ে নিতে অনেক চেষ্টা করেও ছাড়িয়ে নিতে পারেননি।
তিনি জানান, সকাল থেকে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। ভেবেছিলেন, সরকারিভাবেই সাক্ষাতের জন্য টিকিট দেয়া হবে। তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন কারাসদস্য বলেন, সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও দেখা মিলবে না। পরে ২শ টাকায় একটি কুপন কিনেছেন। টাকা নিলেও কোনো রশিদ না দেয়ায় তিনি বলেন, রশিদে টাকার অংক না লেখা মানে ‘মারিং-কাটিং’ করা।
রাজধানীর মিরপুর থেকে কারাগারে বন্দী সায়মনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তার মা। ছেলে গুলিস্তান মার্কেটে কাজ করতেন। তিনি নিজে মিরপুরে অ্যাম্ব্রোয়েডারি দোকানে কাজ করেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, জেলখানায় যেন শত্রুকেও না আনে। এখানে টাকা ছাড়া দেখা হয় না, খাবার মেলে না। তার ছেলে এলাকার দুষ্টু এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর খপ্পড়ে পড়ে। পুলিশ অভিযান চালালে ছয়পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়।
সায়মনের মা বলেন, ছেলে আমার রোজগেরে। ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। তাকে ফেরাতেই ঋণ করে কোর্ট-হাজতে জামিনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন।
গতকাল জেলহাজত থেকে ছাড়া পেয়ে এক আসামি তাকে জানিয়েছেন, কারাগারের ভেতরে তার ছেলে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে না দেখা করলে তাকে মারধর করা হবে।
আর এ খবর পেয়েই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন এই নারী। আর তার জন্য ১শ টাকা দিয়ে কুপন কিনেছেন তিনি।
পটুয়াখালী সদর থেকে বন্দী নাতির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন ৭০ বছরের এক বৃদ্ধা। টাকা না থাকায় কারা সদস্যের কাছে একটি কুপন দেয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করছিলেন তিনি। কারাসদস্য বৃদ্ধাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘ওই দুরে গিয়া বইয়া থাক। দুপুরে বিনামূল্যের টিকেট দিবো, তখন নাতির দেখা পাইবা।’
সেলিম নামে এক যুবক জানান, বিনামূল্যের কুপন নামে চালু আছে। ওই কুপন নিয়ে গেলে ভেতরে পাহাড়ারত সদস্যরা বন্দীদের ডেকে দিতে চান না। আর যদি ডেকে দেনও একসঙ্গে বহু মানুষ থাকায় ভালো করে কথা বলা যায় না।
সেলিম জানান, ১শ ও ২শ টাকার কুপনে গ্রিলের একটু কাছ থেকে কথা বলা যায়। আর ৯শ টাকার কুপনে প্রধান কারা ফটকের সামনে গিয়ে দেখা করা যায়।
দীর্ঘ সময় কারাগারের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখে এই প্রতিবেদকের কাছে কারা সদস্যরা জানতে চান, ভেতরে কেউ আছেন কি না। সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে হাঁক-ডাক দিয়ে চা-সিগারেট নিয়ে আসতে একজনকে সহকর্মীকে নির্দেশ দেন। কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই বলতেই বাইরে প্রচণ্ড গরম বলে ঠান্ডা পানীয় এনে খাওয়ার অনুরোধ জানান। এক পর্যায়ে এসব ব্যাপারে বড় স্যারদের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ জানান।
এসব বিষয়ে জানতে দুপুর ১টায় জেল সুপারের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান প্রধান ফটকে কর্তব্যরত কারারক্ষী।
সূত্র ঃ জাগোনিউজ২৪.কম