জনশক্তি রপ্তানির মন্দাভাব কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) এক লাখ ৯০ হাজার ৮৬৮ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। যা গত বছরের উক্ত সময়ে ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৩৭৫ জন। অর্থাৎ গত বছরের থেকে এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে ৮১ হাজার ৪৯৩ জন কর্মী। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারেরও বেশি কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন। কর্মী যাওয়ার এ হার বজায় থাকলে চলতি বছরে সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি জনশক্তি রপ্তানি হবে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে রাশিয়া। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে চাহিদাপত্র (ডিমান্ড লেটার) দিয়েছে দেশটি। একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াতে সরকারিভাবে সীমিত পরিসরে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি শুরু হচ্ছে এ বছর থেকে। এছাড়া খুব শীঘ্রই সৌদি আরবে গৃহকর্মীর (নারী) পাশাপাশি তাদের সঙ্গে একজন করে নিকটাত্মীয় পুরুষকর্মীও যাওয়া শুরু করবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে চলতি এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত (বাকি কয়েক দিনের হিসাবে আসেনি) মোট ২ লাখ ৯ হাজার ৩২৭ জন কর্মী বিভিন্ন দেশে গেছেন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৬৩ হাজার ৯৯৮ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৬২ হাজার ২৪ জন এবং ৬৪ হাজার ৮৪৬ জন বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে নারী কর্মী রয়েছে যথাক্রমে ১১ হাজার ৬৪৪ জন, ১০ হাজার ৮৭৭ জন, ১৩ হাজার ৫৮ জন। মোট নারী কর্মী বিদেশ গেছে ৩৫ হাজার ৫৭৯ জন। সবচেয়ে বেশি গেছে সৌদি আরবে ২০ হাজার ৩৬ জন। আর চলতি এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে আরও সাড়ে ১৮ হাজার ৪৫৯ জন কর্মী। ২০১৫ সালের পুরো বছরে যেখানে মালয়েশিয়ায় ৩০ হাজার ৪৮৩ জন কর্মী গেছেন, সেখানে চলতি বছরের প্রথম সাড়ে তিন মাসেই দেশটিতে কর্মী গেছে (জানুয়ারি-এপ্রিলের ১১ তারিখ পর্যন্ত) ২৪ হাজার ৭৪ জন। একইভাবে গত বছরের চেয়ে ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুরে উল্লেখযোগ্য হারে কর্মী প্রেরণ বেড়েছে।
বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ১৬০টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ২ লাখ ৯ হাজার ৩২৭ জন। মধ্যপ্রাচ্যের ১১টি দেশেই গেছে এক লাখ ৯৮ হাজার ৪০৮ জন। মাত্র ১০ হাজার ৯১৯ জন গেছে বাকি ১৪৯টি দেশে। জনশক্তির রপ্তানি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছেন ওমানে ৫৩ হাজার ৯২০ জন। এরপর যথাক্রমে কাতারে গেছে ৩৭ হাজার ৮৫৫, সৌদি আরব ৩৩ হাজার ৩৩, মালয়েশিয়া ২৫ হাজার ৭৪, সিঙ্গাপুরে গেছে ৪০ হাজার ৭৮৬, বাহরাইন ১৩ হাজার ৬০৮, জর্ডান ৭ হাজার ১৩৮, কুইয়েত ৫ হাজার ২০২, লেবালন ৪ হাজার ৭৩৮, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২ হাজার ৬৫৫ জন কর্মী গেছেন। এছাড়া অল্প পরিসরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাকি কর্মী গেছে। তবে পর্যাপ্ত ভিসা অনুমোদন থাকার পরও যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় কর্মী প্রেরণ কয়েক মাস হলো বন্ধ রয়েছে। কর্মী যায়নি সুদানেও।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার গবেষণা সেল) মো. আবদুর রউফ বলেন, চলতি বছরে জনশক্তি রপ্তানির হার বেড়েছে। নতুন শ্রমবাজারের সন্ধানে আমরা কাজ করছি। কোন দেশে কী ধরনের কর্মী লাগবে তা দেখা হচ্ছে। সেভাবে আমাদের শ্রমবাজার গবেষণা সেল কাজ করছে। শীঘ্রই বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সঙ্গে রাশিয়া নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে রাশিয়া হতে দুই শ’- দুই শ’ করে মোট চার শ’ জনের ডিমান্ড লেটার পাওয়া গেছে। গার্মেন্টস, কনস্ট্রাকশনসহ জেনারেল (বিভিন্ন) খাতে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে এসব কর্মী যাবে। এদিকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত বছর সৌদি আরবের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হলেও গৃহকর্মীই (নারী) বেশি যাচ্ছে। খুব শীঘ্রই সৌদি আরবে একজন নারীকর্মীর সঙ্গে একজন করে তাদের নিকটাত্মীয় পুরুষকর্মী যাবে। জয়েন্ট টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠকে সৌদি প্রতিনিধিদল এমন কথাই জানিয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানী ক্যানবেরাতে দায়িত্বরত বাংলাদেশ হাইকমিশনার কাজী ইমতিয়াজ হোসেন জানিয়েছেন, চলতি বছরের যেকোন সময় বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়াতে সরকারিভাবে সীমিত পরিসরে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি শুরু হবে। খুব ছোট পরিসরে হলেও ওয়েল্ডার এবং ইলেকট্রিশিয়ানসহ বিশেষ কিছু কাজের জন্য রিকুইজিশন ইতোমধ্যে আমরা এখানে পেয়েছি। বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে রিক্রুটমেন্টের প্রথম পর্যায়ে সিলেকশনের একটা প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। অদক্ষ এবং আধাদক্ষদের দক্ষ করে তোলার মধ্য দিয়ে তথা আমাদের কর্মীদের স্কিলকে ডেভেলপ করে অস্ট্রেলিয় শ্রমবাজারের চাহিদার আলোকে নতুন উদ্যমে আমরা কাজ শুরু করেছি।
জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাগজে-কলমে ১৬০টি দেশে জনশক্তি পাঠানোর কথা বলা হলেও এখন ১৪০টি দেশে যে পরিমাণ কর্মী যাচ্ছে, সে সংখ্যা হাতে গোনা। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমের অন্য বড় বাজারগুলোতে প্রকৃত অর্থে সেভাবে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে না। সরকারের উচিত রিক্রুটিং এজেন্সির সহযোগিতায় নতুন নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ করা, যেন সেই বাজারে সত্যিকার অর্থেই কর্মী পাঠানো যায়। এছাড়া অন্যান্য জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশের শ্রমিকরা আমাদের দেশের শ্রমিকদের থেকে অনেক বেশি প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ও দক্ষ। তাই চাহিদা মতো শ্রমিক দিতে না পারায় তার পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক নিচ্ছে। এজন্য কর্মীদের পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন, ভাষা ও চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে পাঠাতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি।
বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৬০টি দেশে ৯৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৮৭ জন কর্মী গেছে। এরমধ্যে প্রোফেসনাল খাতে গেছে ২ লাখ ২৩ হাজার ২৪৬ জন বা ২ দশমিক ৩০ শতাংশ, প্রশিক্ষণ নিয়ে গেছে ৩০ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩৬ জন বা ৩১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, অর্ধেক প্রশিক্ষণ নিয়ে গেছে ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৫৪ জন বা ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ, কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই গেছে ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯৯১ জন। যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০০৮ সালেই সবচেয়ে বেশি আট লাখ ৭৫ হাজার কর্মী বিদেশে গেছে। ২০০৯ সালে জনশক্তি রপ্তানি নেমে আসে অর্ধেকে, সেবার গিয়েছিল চার লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন। ২০১০ সালে তিন লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জন শ্রমিক বিদেশে যায়। ২০১১ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানির হার আবার বাড়তে থাকে। সে বছর যায় পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ৬২ জন। ২০১২ সালে যায় ছয় লাখ সাত হাজার ৭৯৮ জন। ২০১৩ সালে ফের হার কমতে থাকে। সে বছর চার লাখ ৯ হাজার ২৫৩ জন বিদেশে যায়। ২০১৪ সালে চার লাখ ২৫ হাজার ৬৮৪ জন। গত বছর (২০১৫) ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন (প্রতিদিন দেড় হাজারের বেশি) কর্মী বিদেশে গেছেন। যা ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি।
উল্লেখ্য, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর নুরুল ইসলাম বিএসসি সিরিজ বিদেশ সফর শুরু করেন। ইতোমধ্যে তিনি থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কাতার ও সৌদি আরব সফর করেছেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠাতে ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তি সই হলেও পরবর্তীতে তা স্থগিত ঘোষণা করে মালয়েশিয়া। এ চুক্তির আলোকে মালয়েশিয়া কর্মী নেয়া শুরু করলে জনশক্তি রপ্তানির হার আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।