
শাহজালাল বিমানবন্দরে মেয়াদোত্তীর্ণ রাডার দিয়ে ঝুঁকিতে চলছে ফ্লাইট উঠানামার কাজ। পাশাপাশি রানওয়ে ক্লিনিংয়ের কাজে ব্যবহৃত যানবাহন ও মেশিনপত্রগুলোও মান্ধাতা আমলের। অধিকাংশ ইকুইপমেন্ট নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বিমানবন্দরে পাখি মারার কাজে নিয়োজিত বার্ড শুটার আর ঘাস কাটার কাজে নিয়োজিত সুইপার দিয়ে দীর্ঘদিন চালানো হয়েছে রানওয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ। এমনকি বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের মান ও সেখানে কর্মরত জনবলের যোগ্যতা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট আকাশে ৩১ মিনিট চক্কর দেয়া ও রানওয়েতে ধাতব বস্তু পড়ে থাকার ঘটনায় গঠিত সিভিল এভিয়েশনের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত সব তথ্য উঠে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ওই ঘটনায় সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে দুটি ও বাংলাদেশ বিমান একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে সিভিল এভিয়েশনের একটি কমিটি তাদের তদন্ত কাজ শেষ করে প্রতিবেদনও প্রায় চূড়ান্ত করেছে। খুব শিগগিরই এ প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হবে। বাকি দুই কমিটির তদন্ত কাজ এখনও চলছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
আরও জানা গেছে, বিমানের যে এয়ারক্রাফট থেকে রানওয়েতে ধাতব বস্তু পড়েছিল সেই এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন পরীক্ষার জন্য জার্মানিতে নেয়া হচ্ছে। জার্মানির লুফথানন্সা এয়ারলাইন্সের মেইনটেন্যান্স শপে পরীক্ষার জন্য এ ইঞ্জিন খোলা হবে। এ সময় ইঞ্জিন প্রস্তুকারী ও মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান, বিমান, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। এরপরই বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন কেন এবং কি কারণে ইঞ্জিন থেকে ধাতব বস্তুগুলো রানওয়েতে পড়েছিল। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে ইঞ্জিনটি জার্মানিতে পাঠানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটির এক সদস্য নিশ্চিত করেছেন। সিভিল এভিয়েশন গঠিত তদন্ত কমিটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শাহজালালের রাডার ব্যবস্থাপনা ও কন্ট্রোল টাওয়ারের অবস্থা বেহাল। প্রায় ৩৩ বছরের পুরনো রাডারের কারণে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন উঠানামা করছে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের দুই শতাধিক উড়োজাহাজ। শুধু রাডার নয়, টাওয়ারের প্রায় ১২টি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ যন্ত্র প্রায় ৩৩ বছরের পুরনো। এসব যন্ত্রাংশের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত থাকে। কিন্তু বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নানাভাবে মেরামত করে এগুলো চালাচ্ছে। জানা গেছে, ফরাসি সরকারের অনুদানে ১৯৮৪ সালে প্রাইমারি রাডার এবং ১৯৮৬ সালে সেকেন্ডারি রাডার স্থাপন করা হয়। স্থাপনের সময় এগুলোর মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ ১০ বছর। সে অনুযায়ী ’৯৪ ও ’৯৬ সালে দুটি রাডারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ মেরামত করে ঝুঁকি নিয়েই রাডার দুটি চালাচ্ছে। যার কারণে রাডার ব্যবস্থা এখন চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করতে পারছে না। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) গাইডলাইন্স অনুযায়ী ২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্বের সব বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি), এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলকভাবে যুগোপযোগী করার কথা। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সে আইনও মানছে না। আইকাও দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাহজালালের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি রাডার স্থাপন, ওয়াইড এরিয়া মাল্টিলেটারেশন (ডব্লিওএএম) ও এডিএস-বি স্থাপন, এটিএস সেন্টার আপগ্রেড, কন্ট্রোল টাওয়ার বিল্ডিং স্থাপন, ভিএইচএস, এক্সটেন্ডেট ভিএইচএস, এইচএফ, মাস্টার ক্লক, আরসিএজি, রেকর্ডিং সিস্টেম, ভিসিসিএস স্থাপন করার জন্য দু’বছর আগে বেবিচককে চিঠি দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি কর্তৃপক্ষ।
সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী সোমবার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন- আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরাপদ বিমান চলাচলের স্বার্থে আরও অনেক আগেই উচিত ছিল অত্যাধুনিক রাডার প্রতিস্থাপন করা। কিন্তু নানা জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। তবে এবার আর কোনো জটিলতা বা প্রতিবন্ধকতাকেই প্রশয় দেয়া হবে না। যে কোনো মূল্যে নতুন রাডার স্থাপন করা হবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হয়েছে। সব কিছু স্বাভাবিক গতিতে চললে আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে কার্যাদেশ দেয়া সম্ভব হবে। সে চেষ্টা চলছে। প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় রাডার প্রতিস্থাপনের যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল তা আজ খোলা হবে। কিন্তু তার আগেই দরপত্রে অংশ নেয়া একটি পক্ষ আদালতে মামলা দিয়েছে। একটি মামলা আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। আবার আরেকটি মামলা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান আরও বলেন, যারা মামলা করে রাডার প্রতিস্থাপনের কাজে প্রতিবন্ধকতা করছেন তারা দেশের শত্রু। এদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তার মতে, সিভিল এভিয়েশনের বিরুদ্ধে মামলাও করবে- আবার ব্যবসাও করবে, তা আর কাউকে করতে দেয়া হবে না।
সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, শাহজালালের প্রাইমারি রাডারটি কাজ না করায় আপাতত জোড়াতালি দিয়ে সেকেন্ডারি রাডার দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। যা দেশের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। সেকেন্ডারি রাডারটি বর্তমানে একটি প্রসেসর দিয়ে চালানো হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার কারণে টানা ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টার বেশি রাডারটি কার্যকর রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
সেকেন্ডারি রাডারটি স্থাপনের সময় এর অ্যান্টেনার ঘূর্ণন গতি ছিল প্রতি মিনিটে ১৫ বার। যন্ত্রাংশ পুরনো হওয়ায় এটি চলমান রাখার স্বার্থে এর ঘূর্ণন সংখ্যা কমিয়ে বর্তমানে প্রতি মিনিটে ৭ বার করা হয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের রাডারের অবস্থা নিরূপণ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাডারটির অধিকাংশ খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহার ও মেরামত অযোগ্য। বর্তমান রাডারটি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থ্যালাস বহু আগেই যন্ত্রাংশ তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে। ১৯৮৭ সালে ৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, ১৯৯৪ সালে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও ২০০৮ সালে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাডারের সম্পূর্ণ সিস্টেম আপগ্রেড করা হয়। এরপরও ৩৩ বছরের পুরনো রাডারটির ঘূর্ণন গতি বাড়ানো ও প্রাইমারি অংশটি সম্পূর্ণ ব্যবহারযোগ্য করা এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তারপরও বারবার মেরামতের নামে সিভিল এভিয়েশনের একটি চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ায় প্রকল্প তৈরি করে যাচ্ছে। একটি চক্র নতুন রাডার না কেনার চেয়ে পুরনো রাডার মেরামতের জন্য আবারও দরপত্রের আয়োজন করেছিল। ওই দরপত্রে মেরামত বাবদ ২৩ কোটি টাকা ব্যয় করার প্রস্তাব করে একটি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, সিভিল এভিয়েশনের একটি সিন্ডিকেট ভুয়া প্রস্তাবের মাধ্যমে ‘অ্যারোনেস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে বাজার মূল্যের চেয়ে ৬ গুণ বেশি দামে ২৩ কোটি টাকার মেরামত কাজ পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সম্প্রতি তা বাতিল করা হয়। সিভিল এভিয়েশনের রাডার আপগ্রেডেশন-বিষয়ক কমিটি বর্তমান রাডারটি পরিবর্তন করে নতুন রাডার স্থাপনের পক্ষে মত দেয়ায় মেরামত বাণিজ্য ভেস্তে যায়।
সিভিল এভিয়েশানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন- বর্তমান সেকেন্ডারি রাডার দিয়ে মাত্র ২শ’ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এজন্য বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হয় উড়োজাহাজের ট্রান্সফন্ডারেরর ওপর। যদি সেটা নষ্ট থাকে তাহলে অনুমানের ওপর কাজ করেন পাইলটরা।
জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী বলেন, নতুন রাডার বসানো হলেও পুরনো রাডারটি ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হবে। সেজন্যই এটা ঠিক করা হবে। এজন্য দরপত্র আহ্বান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বচ্ছতা বজায় রেখে উন্মুক্ত দরপত্র ডাকা হবে। যাতে কেউ কোনো ফায়দা নিতে না পারে।