হোটেল–রেস্তোরাঁয় ‘সার্ভিস চার্জ’ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি

দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁয় প্রায়ই খাবারের দাম বাড়ানোর অভিযোগ শোনা যায়। খাবারের ও খাবার পরিবেশনের মানোন্নয়ন না হলেও দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে পণ্যের দামে বেড়ে যাওয়ার দোহাই দেওয়া হয়। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁয় আদায় করা ‘সার্ভিস চার্জ’র বিষয়টি।

অবসরে যাওয়া আলোচিত অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবীর (মিলন) হোটেল–রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর অতিরিক্ত অর্থ হিসাবে ‘সার্ভিস চার্জ’ বা পরিষেবা মূল্য আদায় নিষিদ্ধ করার দাবিতে সম্প্রতি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এমনকি এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) বরাবর চিঠিও দিয়েছেন।

অবশ্য হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার বিলের পাশাপাশি অতিরিক্ত ‘সার্ভিস চার্জ’ নেওয়া যায় কি না সে বিষয়ে ভিন্ন ভিন্নমত এসেছে আইনজীবীদের পক্ষ থেকে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে এ বিষয়ে কিছু বলা আছে কি না, সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো মন্তব্য মেলেনি।

জানতে চাইলে মো. মাহবুব কবীর মিলন জাগো নিউজকে বলেন, এসব নিয়ে কোনো কথা বলবো না। এ বিষয়ে অলরেডি চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি ভোক্তা অধিকারে। চিঠি চলে গেছে এবং ভোক্তা অধিকারের ডিজির সঙ্গেও কথা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব স্যারকেও চিঠি দিয়েছি। ওনারা সবাই চিঠি দেখেছেন।

তিনি বলেন, আমি নির্দিষ্ট কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করিনি। আমি শুধু ভোক্তা আইনটা উল্লেখ করেছি। এরা কীভাবে নেয়, ভোক্তা আইন অনুযায়ী বিধি লঙ্ঘনের শামিল এবং ক্রেতাদের হয়রানি হচ্ছে, আইন উল্লেখ করেছি। ধারা উল্লেখ করে বলছি যে, এ আইনের ধারায় মহাপরিচালককে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন হলে উনি যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন। কাজেই এটা (সার্ভিস চার্জ) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা প্রয়োজন বলে অনুরোধ করেছি তাকে।’

এক্ষেত্রে ভারতের উদাহরণ টেনে মাহবুব কবীর মিলন বলেন, চিঠি দিয়ে বা ভারতের মতো গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সার্ভিস চার্জ নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।

এর আগে মাহবুব কবীর মিলন তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া স্ট্যাটাসে লেখেন, “ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী ‘সার্ভিস চাজ’ নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবার মানে পণ্য কিনছেন এবং বসে খাবার ব্যবস্থা থাকায় বসে খেয়েছেন। সেখানে সার্ভিস চার্জ নেওয়া ভোক্তা আইনে লঙ্ঘন। হতবাক হওয়ার কিছু নেই। একজন রশিদ অডিও, ভিডিও নিয়ে অভিযোগ করুন ভোক্তায়। এরপর আমাকে জানাবেন।”

অবশ্য এক্ষেত্রে ভিন্নমত মিলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন— হোটেল-রেস্তোরাঁ আলাদা ‘সর্ভিস চার্জ’ নিতে পারে না। আবার কেউ বলছেন— ‘সার্ভিস চার্জ’ নেওয়া যায়, কারণ তারা সেবা দিচ্ছেন। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কিছু আছে কি না সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, যেটা প্রচলিত বকশিস বা টিপস সেটা তো নিয়ে থাকে। আমরা হয়তো কোনো অনুষ্ঠানে হোটেল রেস্তোরাঁয় গেলাম, সেখানে ওয়েটার বা অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো জিনিস এগিয়ে দিলো, টিস্যু এবং হ্যান্ডওয়াশ করে দিলো, আমরা হয়তো তাকে টিপস (বকশিস) দিয়ে থাকি।

সিনিয়র এ আইনজীবী আরও বলেন, কেউ হয়তো হোটেল রেস্তোরাঁয় কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করার পরে সে আগে থেকেই চিন্তা বা পরিকল্পনা করে থাকেন কিছু টিপস (বকশিস) দিতে হবে। এটা একটা প্রথা বা প্রচলন হয়ে আসছে। কিন্তু সেবা দেওযার কারণে সার্ভিস চার্জ দিতে গ্রাহকদের বাধ্য করা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন তিনি।

তিনি জানান, সেবা দেওয়ার কারণে সার্ভিস চার্জ দিতে গ্রাহকদের বাধ্য করা এটা ঠিক না। গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার পরে সার্ভিস চার্জ নামে আরো কিছু অর্থ দাবি করা উচিত হবে না।

সার্ভিস চার্জ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হোটেল–রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর অতিরিক্ত অর্থ হিসাবে ‘সার্ভিস চার্জ’ বা পরিষেবা মূল্য আদায় ওই ভাবে করা হয় না। তবে আমাদের দেশে নয় বিশ্বের সব দেশেই এমন নিয়ম আছে যেখানে হোটেল–রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর অতিরিক্ত অর্থ হিসাবে ‘সার্ভিস চার্জ’ দিতে হয়। তবে, আমাদের দেশে এ বিষয়ে কোন ধরা-বাধাঁ কোনো নিয়ম নেই। আমাদের এখানে “সার্ভিস চার্জ” না দিলেও টিপস (বকশিস) দেওয়ার প্রচলন আছে। যদিও সেটা ‘সার্ভিস চার্জ’ না।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার ড. মো. বশির উল্লাহ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশই ‘সার্ভিস চার্জ’ আছে। এমনকি বাংলাদেশের যেগুলো বড় বড় রেস্টুরেন্ট, যারা মানি রিসিড দেয় এরাও গ্রাহকের কাছ থেকে ‘সার্ভিস চার্জ’ নেয়।

তিনি বলেন, ছোট্টখাটো রেস্টুরেন্ট যেগুলোতে আমরা বসে খেয়ে আসি তারা হয়তো ‘সার্ভিস চার্জ’ নেন না। কিন্তু আমাদের দেশের বড় বড় রেস্টুরেন্টগুলো কিন্তু ‘সার্ভিস চার্জ’ নিয়ে থাকেন সেটা লেখা থাকে না, আসলে কিন্তু তারা সবমিলিয়ে নেয়।

ড. বশির উল্লাহ বলেন, ‘সার্ভিস চার্জ’ নেয়। তবে হয়তো বা আমাদের গরিব দেশে সার্ভিস চার্জ কেন চায় প্রশ্ন আসতে পারে। যেসব কর্মচারীরা গ্রাহকদের খাবার সার্ভ করেন তাদের বেতন দেওয়া হয়। ছোট্ট রেস্টুরেন্ট আর বড় রেস্টুরেন্ট সবাই। ছোট্ট রেস্টুরেন্ট হয়তো নেয় না। ধরুণ, পরোটা, সিঙ্গারা, সমুচা, পুরি খাওয়ার পরে তারা হয়তো ‘সার্ভিস চার্জ’ নিলো না। তবে, তারা চাল, ডাল এবং কর্মচারীর বিষয়টি মাথায় রেখেই খাবারের দাম ধরে নির্ধারণ করে রাখা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী টিপস নিয়ে বলেন, টিপসটা হলো আলাদা জিনিস। যেমন আমেরিকাতে ‘সার্ভিস চার্জ’ নেয় না। কোন কোন রেস্টুরেন্ট বলেন, আপনি যা দেন। টিপস দেওয়াটা বাধ্যতা মূলক না। এখন এটা একেবারে অনৈতিক এটা বলা যাবে না। তিনি বলেন, ‘সার্ভিস চার্জ’ নিয়ে এখনো কোনো বাধ্যবাধকতা ও আইন এখনো দেশে হয়নি।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.