হজের প্রাক নিবন্ধনে পাঁচদিনেই কোটা পূরণ

TOPSHOTS Muslim pilgrims perform the final walk (Tawaf al-Wadaa) around the Kaaba at the Grand Mosque in the Saudi holy city of Mecca on November 30, 2009. The annual Muslim hajj pilgrimage to Mecca wound up without the feared mass outbreak of swine flu, Saudi authorities said, reporting a total of five deaths and 73 proven cases. AFP PHOTO/MAHMUD HAMS (Photo credit should read MAHMUD HAMS/AFP/Getty Images)

বুয়েট বিশেষজ্ঞের সার্বক্ষণিক কঠোর নজরদারিতে শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রেখে এ বছরের বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের প্রাকনিবন্ধন চলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর মাত্র পাঁচদিনেই সংরক্ষিত কোটা পূরণ হয়ে যাওয়ায় এখন চলছে অতিরিক্ত প্রাকনিবন্ধন। নিবন্ধন চলাকালীন একাধিকবার কয়েকটি এজেন্সির হ্যাকাররা সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে অন্তত পাঁচ হাজার হজযাত্রীর নাম অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। বুয়েট বিশেষজ্ঞরা তা নস্যাৎ করে দিয়েছেন।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত মোট এক লাখ ৩৭ হাজার ২০৮ হজ গমনেচ্ছু প্রাকনিবন্ধন করেন। চলতি বছর বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় সৌদি আরবে হজে পাঠানোর জন্য কোটা বরাদ্দ রয়েছে মোট এক লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ জনের। সে হিসেবে ইতোমধ্যেই বেসরকারী কোটার নির্ধারিত অতিরিক্ত ২০ হাজার হজ গমনেচ্ছুর প্রাকনিবন্ধন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গত বছরের প্রাকনিবন্ধনকৃত আরও ৩৭ হাজার ৪৯৪ জন।

চলতি বছর মোট এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরব যাওয়ার কোটা রয়েছে। তার মধ্যে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ১০ হাজার এবং বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ জনের কোটা নির্ধারিত রয়েছে। এ হিসেবে প্রাকনিবন্ধনের অন্তত পঞ্চাশ হাজার জনকে অপেক্ষায় থাকতে হবে আগামী বছরের জন্য।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর প্রাকনিবন্ধন শুরু হয়েছে গত বছরের সিরিয়াল ১ লাখ ৪০ হাজার ৯৯৫ জন নাম্বার থেকে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রাকনিবন্ধনের সিরিয়াল গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২০২-এ। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে মোট এক হাজার ৯৭ এজেন্সির মাধ্যমে বেসরকারী ব্যবস্থাপনার প্রাকনিবন্ধন শুরু হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিযুক্ত আইটি ফার্ম বিজনেস অটোমেশানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বজলুল হক বিশ্বাস জানিয়েছেন, এটি চলমান প্রক্রিয়া। সারাবছরই চলবে প্রাকনিন্ধন যাতে সুষ্ঠুভাবে ধীরে স্থিরে নির্ভুলে হজ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়।

তিনি ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, আগামী ২০২৩ সাল পর্যন্ত কারা হজে যাবেন তাদের তালিকা প্রাকনিবন্ধন করা হয়ে গেছে সে দেশে। যিনি সিরিয়ালে এগিয়ে থাকবেন তিনিই হজে যাবেন। তদ্বীরের মুখে কাউকে খাতির করে সিরিয়াল ভঙ্গ করার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশেও এই নীতি অনুসরণ করা উচিত।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও বুয়েট বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ কমিটির সার্বক্ষণিক নজরদারিতে প্রাকনিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ায় সুবিধা করতে পারেনি অসাধু হজ এজেন্সিগুলো। নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরুর দিন থেকেই বেশ কয়েকটি হজ এজেন্সি তাদের পছন্দ মতো অন্তত পাঁচ হাজার যাত্রীর জন্য বিশেষভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালায়। এতে সুবিধা করতে না পেরে তারা অনৈতিক পন্থায় চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু বিজনেস অটোমেশান হজ এজেন্সিগুলোর অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দিলেও এখনও তৎপর রয়েছে ওই সিন্ডিকেট।

ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সৌদি আরবের ই-হজ সিস্টেমের সঙ্গে সমন্বয়সহ প্রাপ্য কোটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গত বছর থেকে এই ডাটাবেজ চালু করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই ব্যবস্থাপনায় হয়রানি, প্রতারণা ও মানবপাচার বন্ধকরণসহ জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও রোহিঙ্গাদের সহজে চিহ্নিত করা অনেকটাই সহজসাধ্য। এতে প্রতারক-দালালদের তৎপরতাও বন্ধ হয়ে গেছে। একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধ্যমে ন্যাশনাল আইডি কর্তৃপক্ষের সমন্বয় রেখে প্রাক নিবন্ধনের কাজ সম্পন্ন করায় কারা কারা অনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে সেটাও সুস্পষ্ট করা সম্ভব। বুয়েট বিশেষজ্ঞের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রাক নিবন্ধন চলাকালীন আলাদা একটি ডেক্সে সার্বক্ষণিক সাইবার ক্রাইম ঠেকানোর বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়।

এ সম্পর্কে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয়কে কোনভাবেই প্রভাবিত করতে না পেরে কয়েকটি এজেন্সি আইটি ফার্ম বিজনেস অটোমেশানের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। টোকাই জামান নামে এক ব্যক্তি সরাসরি কমপক্ষে ৫ হাজার যাত্রীকে বিশেষ সুবিধায় প্রাকনিবন্ধন তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। এ বিষয়টি বিজনেস অটোমেশনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক বুয়েট বিশেষজ্ঞ ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়। এরপর প্রাকনিবন্ধন প্রক্রিয়া বিশেষ নজরদারি রাখা হয়।

সূত্র জানায়, হজযাত্রী প্রতি অতিরিক্ত বিশ হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব কাজে না আসায় অসাধু চক্রটি সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে তা সফল করারও চেষ্টা চালায়। এ প্রাকনিবন্ধন শুরু হওয়ার তৃতীয় দিন গত মঙ্গলবার সাইবার আক্রমণ চালানোরও অপচেষ্টা হয়েছে। এজন্য প্রাকনিবন্ধন চলার অফিস সময় সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সার্ভার পাহারা দেয়া হয়েছে। এর দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বাইরের থেকে যে সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে গোটা প্রযুক্তিকে হ্যাক করার চেষ্টা চালানো হয়েছে তাও ধরা পড়েছে। কারা কারা কোন কোড থেকে এই ক্রাইম করার চেষ্টা চালিয়েছে সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, কিছু এজেন্সি ও তাদের দালালদের হাতে দীর্ঘদিন থেকে হাজীরা হয়রানি প্রতারণার শিকার হয়ে আসছিলেন। সেসব বন্ধেই সরকার ২০১৬ সালে জাতীয় হজ ও ওমরাহ নীতিমালা করে। তারই আলোকে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনা ও তথ্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের জন্য ‘হজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ ডিজিলাইজড করার উদ্যোগ নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। এ প্রক্রিয়ায় হজ যাত্রীরা কোন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন না এবং সহজেই নিয়মমাফিক প্রক্রিয়াগুলো শেষ করে হজে যেতে পারবেন। বিলম্বে নিবন্ধন করার কারণে কোটা শেষ হয়ে গেলেও নিবন্ধন বাতিল না করলে পরবর্তী বছর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিনি হজে যেতে পারবেন। তার সম্পূর্ণ তথ্য সংরক্ষিত থাকবে ডাটাবেজে। প্রাক নিবন্ধন পদ্ধতি হজে যাওয়ার প্রক্রিয়াগুলোর প্রথম ধাপ। এ পর্যায়ে জাতীয় পরিচয়পত্র, আর ১৮ বছরের নিচে হলে জন্ম নিবন্ধন সনদ, প্রবাসী হলে প্রবাস সংক্রান্ত কাগজপত্র ও মোবাইল ফোন নম্বর দিতে হয়। এসব কাগজপত্র ও প্রাক নিবন্ধনের জন্য সরকারের নির্ধারিত ফি ও জামানতের টাকা নিয়ে যারা সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে চান তাদের ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যালয় কিংবা ঢাকার হজ অফিসে যোগাযোগ করতে হয়।

একইভাবে বেসরকারী ব্যবস্থাপনায়ও যারা হজে যেতে চান, তাদের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত বৈধ হজ এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। হজ তাদের কাছ থেকে পাওয়া ট্র্যাকিং নম্বরযুক্ত কাগজসহ ফি ও জামানতের টাকা নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এরপর ব্যাংক থেকে হজের প্রাকনিবন্ধন সনদ এবং মোবাইল নম্বরে এসএমএস পাঠানো হবে। এতেই নিশ্চিত হওয়া যাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রাকনিবন্ধন শেষ হয়েছে। এছাড়া হজের ট্র্যাকিং নম্বর দিয়ে হজের ওয়েবসাইট থেকে টাকা জমা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এ প্রক্রিয়ায় সাইবার ক্রাইম হয়েছে বলে হাব-এর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজনেস অটোমেশানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাবেক অতিরিক্ত সচিব বজলুল হক বিশ্বাস বলেন, প্রাকনিবন্ধনের কাজ শুরু থেকেই তদারকির জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি টিম, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সিস্টেম এ্যানালাইসিস্ট, হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠন ‘হাব’ এর তিন সদস্য এবং বুয়েটের দু’জন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী বিজনেস অটোমেশনের কাজ নিয়মিত তদারকি করছেন। প্রাকনিবন্ধন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হজে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের যাবতীয় তথ্য ডাটাবেজে সংরক্ষিত হয়ে যাবে। কেউ নিবন্ধন বাতিল করলেও তার তথ্য থেকে যাবে। এই ডাটাবেজের সঙ্গে এনআইডির সার্ভারের লিঙ্ক রয়েছে। যেন সহজেই সংশ্লিষ্ট হজযাত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে নেয়া যায়। এ কারণে প্রাকনিবন্ধন পদ্ধতি ও ডাটাবেজে হজ যাত্রীদের তথ্য সংরক্ষণের কারণে মানবপাচার, বাংলাদেশী পরিচয়ে রোহিঙ্গাদের সৌদি আরব যাওয়া, জঙ্গী ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা অনেক সহজ হয়েছে। হজে গিয়ে সৌদি আরব থেকে যাওয়ার আশঙ্কাও শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে এ পদ্ধতি চালু হওয়ার একজন রোহিঙ্গাও বাংলাদেশী পরিচয়ে হজে যাওয়ার নাম করে সৌদি আরব যেতে পারেননি। এছাড়া এ বছর যিনি হজ করবেন তিনি পরবর্তী তিন বছর আর হজে যেতে পারবেন না। তবে মাহরাম হিসেবে যেতে যে কেউ তিন বছরের মধ্যে যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে কোন বাধা নেই। এমন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সাইবার ক্রাইম হওয়ার বিন্দুুমাত্র উপায় নেই। কেউ চাইলেও সেটা সিস্টেমে এলাউ করবে না। এ সফটওয়্যার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে কোন ব্যক্তি বা বিজনেস অটোমেশান চাইলেও সেটা করা যাবে না। এমনকি হ্যাকাররা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির কারণে তাদের হামলা থেকেও রক্ষা পেয়েছে বিজনেস অটোমেশান।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.