প্রায় সাত বছর বন্ধ থাকার পর গত এপ্রিলে চালু হয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট। প্রচারণার অংশ হিসেবে আগামী জুন পর্যন্ত সব রুটেই ২ হাজার ৭০০ টাকায় যাত্রী পরিবহনের ঘোষণা দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইনসটি। এতে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী পেতে হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি চার এয়ারলাইনস। বাধ্য হয়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এরই মধ্যে ভাড়া কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে কম টাকায় টিকিট বিক্রি হওয়ায় বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর তুলনায় বেশি যাত্রী পাচ্ছে বিমান। কিন্তু প্রমোশনাল অফার শেষে যখন স্বাভাবিক দামে টিকিট বিক্রি শুরু হবে, তখন বিমানের যাত্রীও কমে যাবে। আর যাত্রী সংকট হলে আগের মতোই অভ্যন্তরীণ রুটে ব্যবসায়িকভাবে লোকসান হবে।
তাদের মতে, সরকার থেকে ভর্তুকি পেয়ে বিমানের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে লোকসানের কারণে বড় ধরনের সংকটে পড়বে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো।
বিমানের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, নভোএয়ার ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। এর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেসরকারি সব এয়ারলাইনসের তুলনায় কম। বিমানে ওয়ানওয়ের জন্য শুল্কসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ভাড়া ৪ হাজার টাকা। এছাড়া ঢাকা-কক্সবাজার ৫ হাজার ৫০০, ঢাকা-সিলেট ৩ হাজার ২০০, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-সৈয়দপুর ও ঢাকা-যশোর ভাড়া ৩ হাজার ৫০০, ঢাকা-বরিশাল ৩ হাজার, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ২ হাজার ২০০ টাকা। তবে প্রচারণার অংশ হিসেবে বর্তমানে সব রুটের ক্ষেত্রেই ভাড়া ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৭০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দিয়ে যাত্রীরা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারবে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সেক্টরে যাত্রী চাহিদার তুলনায় এয়ারলাইনসগুলোর আসন সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি। এয়ারলাইনসগুলোর দৈনিক আসন সক্ষমতা গড়ে ৩ হাজার ৮০০ হলেও এর বিপরীতে যাত্রী রয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ জন। এ অবস্থায় বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর পক্ষে পরিচালন ব্যয় মিটিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মফিজুর রহমান বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের ফ্লাইট চলতেই পারে। তবে এজন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় রাখতে হবে। কারণ বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোকে বিমানবন্দর ব্যবহারসহ বেবিচকের বিভিন্ন চার্জ পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া জ্বালানি খরচ, ভ্যাটসহ আরো অনেক খরচ রয়েছে। এতে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর পরিচালন ব্যয় বেড়ে যায়। অন্যদিকে বিমানকে অনেক চার্জই পরিশোধ করতে হয় না। লোকসান হলে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থসহায়তা দেয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, সব ধরনের চার্জ পরিশোধের পর যদি বিমান কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করতে পারে, সেটা ভালো। অন্যথায় বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি বিমানও লোকসানে পড়বে, যা শেষ পর্যন্ত এ খাতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
তবে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর এ বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ বহুদিনের। ১ ঘণ্টারও কম সময়ের ফ্লাইটে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের আকাশপথের ভাড়া ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক রুটের সমান।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যশোর থেকে ঢাকা রুটে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার ৪০০ টাকা, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ভাড়া ৪ হাজার ৪০০ থেকে ৭ হাজার টাকা, নভোএয়ারের ভাড়া ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে এ রুটে বিমানের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে থাকলে যাত্রীদের অনেকেই উড়োজাহাজে চড়তে উত্সাহিত হবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রুটের ব্যবসাও চাঙ্গা হবে।
জানা গেছে, টানা দুই বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং হরতাল-অবরোধে যাত্রীরা বিকল্প হিসেবে আকাশপথে যাতায়াতে অভ্যস্ত হয়েছে। ফলে কয়েক বছর আগেও অভ্যন্তরীণ রুটে বছরে মাত্র লাখ দুয়েক যাত্রী থাকলেও বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সাত লাখ যাত্রী পরিবহন করছে এয়ারলাইনসগুলো।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২০১৪ সালে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী পরিবহন হয় ৬ লাখ ৮০ হাজার ৪২০ জন। ২০১৩ সালে যা ছিল ৬ লাখ ৪৮ হাজার ১৯, ২০১২ সালে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ১০৮, ২০১১ সালে ৫ লাখ ২৭ হাজার ৯৫০, ২০১০ সালে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৩৩ ও ২০০৯ সালে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৬১৭ জন।
অভ্যন্তরীণ রুট প্রসঙ্গে বিমান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, বেসরকারি খাতে দেশের এভিয়েশন সেক্টর এখনো শৈশবে রয়েছে। খাতটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলেও বিমানের উচিত অভ্যন্তরীণ রুটে ভাড়া নিয়ে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ করা। অন্যথায় লোকসানে পড়ে অতীতের মতো ঝরে যাবে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো। তিনি বলেন, বেবিচক ও পদ্মা অয়েলের পাওনার মতো পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ করে না বিমান। আর যে ৩০ শতাংশ ব্যয় করে তারও জবাবদিহিতা নেই। অন্যদিকে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোকে সব ব্যয় মিটিয়ে ব্যবসা করতে হয়।