বিএনপি নির্বাচন বর্জ​ন করলে স্বস্তি পাবে আওয়ামী লীগ

বিএনপি নির্বাচন বর্জ​ন করলে স্বস্তি পাবে আওয়ামী লীগ।

ভোটের বাকি আর চার দিন। এখন পর্যন্ত ভোটের মাঠ একচেটিয়া আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। প্রচার-প্রচারণায়ও আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের ধারেকাছে নেই বিরোধীরা। তারপরও আওয়ামী লীগে অস্বস্তি আছে। বিএনপি জোট ভোটের দিন ব্যাপকভাবে মাঠে নেমে ভোটকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় কি না, এ আশঙ্কা থেকেই মূলত অস্বস্তি। এ জন্য শেষ সময়ে চাপে পড়ে বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে স্বস্তি পাবে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপি জোটকে চাপে রেখে নির্বাচনে আনা এবং ভোটের মাঠে নামতে না দেওয়ার পরিকল্পনা আগেই করা হয়েছিল। পুলিশ ও প্রশাসন সেই ছক মেনেই কাজ করছে। সেনাবাহিনী নামার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে বলে বিএনপির যে আশা ছিল, সেটাও হয়নি। এ অবস্থায় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে, এমন প্রচারণা চলছে দুদিন ধরে। অবশ্য এ ​বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি।

বিরোধীদের ভোট বর্জনের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগ সমঝোতার বাইরেও মহাজোটের শরিকদের নিজ নিজ দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দিতে উৎসাহ দিয়েছে। মহাজোটের প্রধান শরিক এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ২৬টি আসন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু জাপা এর বাইরে আরও ১৪৮ আসনে প্রার্থী দিয়ে রেখেছে। একইভাবে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরীকত ফেডারেশন, জেপি, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, বাসদ, সাম্যবাদী দল এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সমঝোতার বাইরে নিজ নিজ প্রতীকে প্রায় দেড় শ প্রার্থী দিয়েছে।

১৪ দল ও মহাজোটের যেসব শরিক কোনো আসন পায়নি, তারাও নিজেদের মতো করে কিছু প্রার্থী দিয়ে রেখেছে। এ জন্য ১৩টি আসনে বিএনপির প্রার্থী শূন্য হয়ে যাওয়ার পরও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ জয়ী হওয়ার সুযোগ নেই।

এখন বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো ভোট বর্জন করলেও ব্যালটে তাদের প্রতীক থাকবে। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বলেই গণ্য হবে। ওই অবস্থায় আওয়ামী লীগের শরিক ও মিত্র দলগুলোর নিজস্ব প্রতীকের প্রার্থীরাও গুরুত্ব পাবে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যেতে পারে—এমন বার্তা যাতে ভোটের মাঠে না যায়, এটা নিশ্চিত করতে শুরু থেকেই সতর্ক ছিলেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। এ জন্য প্রচারের প্রথম দিন থেকেই সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করছে সরকারি দল। বিএনপি যাতে মাঠে নামতে না পারে, সে জন্য শক্তি প্রয়োগ ও প্রশাসনিক চাপ অব্যাহত রাখা হয়। বিএনপির নেতা–কর্মী ও সমর্থকদের আরও পরিষ্কার বার্তা দেওয়ার জন্য বেছে বেছে প্রার্থীদেরও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। বহুমুখী চাপে বিএনপিসহ বিরোধীরা কার্যত এখন কোণঠাসা। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বৈঠকে এর প্রভাব দেখা গেছে।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসছে—মানুষের মধ্যে এমন ধারণা তাঁরা দিতে পেরেছেন। এখন নানা মহলে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, আওয়ামী লীগ কটি আসন পাচ্ছে আর বিরোধীদের ভাগে কয়টা পড়ছে। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ ১৭০-১৮০ আসন পেতে যাচ্ছে। বিএনপি জোট কয়টি আসন পাবে, তা নির্ভর করছে ভোটের দিনে তাদের আচরণের ওপর।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, বিএনপি জোট ভোট বর্জন না করলে ভোটের দিন সংঘাতের আশঙ্কা আছে। তবে ভোটের দিন প্রাণহানি ও সংঘাত যাতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগের বড় লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে বিএনপি মাঠে থাকলে সংঘাত-প্রাণহানি অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এ জন্য চাপের মুখে বিএনপি শেষ সময়ে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে সরকারি দল স্বস্তি পাবে।

ওই সূত্রটি জানায়, এমন সম্ভাবনা মাথায় রেখেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানোর জন্য সমঝোতার বাইরেও এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা) ও মহাজোটের অন্য শরিকদের নিজ নিজ প্রতীকে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে অমত করেনি আওয়ামী লীগ।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৩ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টি, ১৪ দল, বিকল্পধারার মধ্যে আসন ভাগাভাগি হলেও তার বাইরে অন্য দলগুলোর নিজ নিজ প্রতীক নিয়ে ভোট করায় আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই। এতে ভোটের ফলে প্রভাব পড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা কৌশল আছে, কৌশলটা তো বলব না। সুস্পষ্ট কৌশল আছে। আমাদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অ্যালায়েন্স দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা না বুঝে দিয়েছি এটা? ইলেকশনের দিন বুঝতে পারবেন, অন্যরা ‍যদি সরে যায় তারপর। এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফাঁদ তৈরি করতে দেব না।’

আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র বলছে, তারা এই নির্বাচনে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কৌশলগুলো প্রয়োগ করছে। গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু সেভাবে সংঘাত কিংবা প্রাণহানি হয়নি। এর কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে বিএনপিকে মাঠছাড়া করা হয়েছিল। বিএনপির প্রার্থীরা বেশির ভাগ কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে পারেননি, দিলেও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি যাতে এজেন্ট দিতে না পারে, সে চেষ্টা চালানো হবে। এ জন্য কয়েক মাস আগে থেকেই ব্যাপকভাবে মামলা দিয়ে বিএনপির নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করা হয়, যা ভোট পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হবে।

আওয়ামী লীগের মনোনীত একজন প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রথমে বিরোধীদের মাঠছাড়া করার পরিকল্পনা ছিল। এতে সফল তারা। কারণ, বিরোধীরা মাঠে থাকলে ভোটের দিন প্রাণহানি হবে। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে সমালোচিত হয়েছে আওয়ামী লীগ। এবার যদি প্রাণঘাতী নির্বাচনের দুর্নাম লেগে যায়, তাহলে দেশে-বিদেশে আবার সমালোচনার জন্ম দেবে। তাই বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে দোষ তাদের ঘাড়েও কিছুটা বর্তাবে।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার-সমর্থক শিক্ষক সংগঠন নীল দলের অন্যতম নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করেই নির্বাচনে এসেছে। তাদের নিশ্চয় ধারণা ছিল তারা জয়লাভ করবে। এখন হয়তো সে ধারণা ভেঙে গেছে বা মানুষের সাড়া পায়নি। এ অবস্থায় যদি তারা বর্জন করে, তাহলে দায় তাদের ওপর বর্তাবে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.