ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ দ্য রাইম অব দ্য এইনশান্ট ম্যারিনার শীর্ষক দীর্ঘ কবিতায় অথৈ সাগরে আটকে পড়া নাবিকদের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছিলেন। লিখেছিলেনÑ ‘ওয়াটার, ওয়াটার, এভরি হোয়্যার,/ নর এনি ড্রপ টু ড্রিংক।’ তৃষ্ণার্ত নাবিকদের চারপাশে বিস্তর জলরাশি, কিন্তু মুখে দেওয়ার মতো এক ফোঁটা জলও তাদের কাছে ছিল না। বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা কবিতার সেই নাবিকদের চেয়েও চরম দুর্দশায় পতিত হয়েছেন নৌপথে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে। তাদের চারপাশে অথৈ জল। কিন্তু লবণাক্ত। মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার বিবিসি জানায়, এমন অসহায় অবস্থায় একটি নৌযানে অথৈ সাগরে ভাসছেন বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গারা থাইল্যান্ডের উপকূলীয় আন্দামান সাগরে। পরিস্থিতি এতটাই হৃদয়বিদারক যে, বাধ্য হয়ে নিজেদের মূত্র পান করে জীবন ধারণ করছেন হতভাগা এই অভিবাসীরা। এরই মধ্যে নৌকাটির ১০ আরোহী করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার আরও ৮শ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের বহনকারী দুটি নৌযানকে ভিড়তে দেয়নি মালয়েশিয়া। এর আগে এ ধরনের অভিবাসীদের তীরে নামতে দেয়নি ইন্দোনেশিয়াও। সে সময় অভিবাসীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) ওই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে। সংগঠনটি এসব অভিবাসীকে তীরে নামতে দেওয়ার আহ্বান জানায়। তবে এতে কান দিচ্ছে না দেশ তিনটি।
নৌকাটির আরোহীদের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, তিন মাস ধরে সাগরে ভাসছেন তারা। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে বঙ্গোপসাগর থেকে রওনা দিয়েছিলেন এসব যাত্রী। ছয় দিন আগে পাচারকারীরা বিকল ইঞ্জিনের একটি মাছ ধরার নৌকায় তাদের ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। তাদের কাছে এখন কোনো খাবার এমনকি পানীয় জলও নেই। পানাহারের অভাবে মরে যাওয়া ১০ জনের লাশ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় কোহ লিপ উপকূলে ভাসতে থাকা নৌযানটির কাছ থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জানান, নৌকাটিতে সাড়ে ৩শ যাত্রী রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। আরোহীদের মধ্যে ৮৪ জন শিশু ও ৫০ জন নারী রয়েছেন। তারা উপকূলে আমাদের চিৎকার করে ডাকছেন এবং করুণ সুরে সাহায্যের আবেদন করছেন। সূর্যের তীব্র তাপ থেকে রক্ষা পেতে নৌকাটি কম্বল দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানকার গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমরা তাদের নৌকার দিকে পানির বোতল থেকে শুরু করে ওষুধ-খাবার যা পারছি ছুড়ে দিচ্ছি। কিন্তু এতে তাদের কতটুকু উপকার হবেÑ তা নিশ্চিত নয়।
রোহিঙ্গাদের বহনকারী নৌকাটিকে তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না থাইল্যান্ড। দেশটির নৌবাহিনী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব অভিবাসী মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন। আমরা তাদের খাদ্য, পানীয় ও ওষুধ দিয়ে সাহায্য করব। কিন্তু তাদের তীরে নামাব না। গত বুধবার রাতে নৌকাটি খুঁজে পায় আমাদের বাহিনী। আমরা সেটাকে মালয়েশিয়া অভিমুখে ছেড়ে দিচ্ছি।
থাই নৌবাহিনীর মেজর জেনারেল ওয়েরাচন সুখনধাপাটিপাক বলেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াÑ কোনো দেশই এসব অভিবাসীকে তীরে ভিড়তে দেবে না। তারা কেউই এসব আরোহীকে গ্রহণ করবে না। সব দেশই তাদের সাগরে ফিরিয়ে দেবে।
আইওএম জানায়, সাগরে এখনো ৮ হাজারে বেশি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসী ভাসছেন। তারা খাবার, পানি ও ওষুধের তীব্র সংকটে ভুগছেন। এসব অভিবাসীর জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। গত রবি ও সোমবারও মালয়েশীয় উপকূল থেকে ২ হাজার অভিবাসী উদ্ধার করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
বিবিসির সংবাদদাতা জানান, সম্প্রতি থাইল্যান্ডের উপকূলীয় একটি জঙ্গল থেকে পাচারকারীদের একটি নির্যাতন কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হয় থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। উপকূলে পাহারা জোরদার করে তারা। ফলে পাচারকারীরা অবৈধ এসব অভিবাসীকে সাগরে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে। এতে আরও দুর্ভোগে পড়েছেন অভিবাসীরা
আরও খবর