এবার সরকারি কর্মকর্তা সাজিয়ে মানব পাচারের ঘটনা ধরা পড়ল। এর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সরকারি বা ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’। এই পাসপোর্ট বানাতে সরকারের অনুমোদন লাগে। বিদেশে যেতে প্রয়োজন হয় সরকারি আদেশ বা জিও। এরপর আছে বিমানবন্দরে অভিবাসন পুলিশের যাচাই। সবকিছু সম্পন্ন করেই সরকারি কর্মকর্তা সেজে চলে যাচ্ছেন অনেকে।
দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় সরকারি কর্মকর্তারা ২০১২ সাল থেকে তুরস্কে ভিসা ছাড়াই যেতে পারেন। সেখান থেকে তাৎক্ষণিক ভিসা নিয়ে যাওয়া যায় ইউরোপের অন্যান্য দেশে। এই সুযোগটাই নিচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি। আর এ কাজে সহায়তা দিচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারাই। অনেক দিন ধরে এভাবে মানব পাচার হলেও এবারই প্রথম তা ধরা পড়ল। তুরস্ক সরকারের দেওয়া এক চিঠির সূত্র ধরে বিষয়টি জানাজানি হয়। তবে ঠিক কতজন এই পথে সরকারি কর্মকর্তা সেজে চলে গেছেন, তা জানা যায়নি। এর জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ চারজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এটা ভয়ংকর ঘটনা। এমন প্রথম শুনলাম। অনাপত্তি সনদও জাল, আবার জিও জাল। এ ঘটনায় যাদেরই জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে।’
সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক চিঠিতে তুরস্ক বাংলাদেশের সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহারকারী এ রকম তিনজনের একটি তালিকা পাঠিয়েছে। এঁরা হচ্ছেন তফিকুল ইসলাম (৫১২৫৮৪৫), মামুনুর রশিদ (৬১২৬০৪২) ও আমিন উদ্দিন (১১২৬৬৩৯)। চিঠিতে জানানো হয়েছে, তুরস্কের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করে এমন আরও ব্যক্তির নাম পাঠানো হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তুরস্কের পাঠানো এ অভিযোগের পর বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে এর সত্যতা পায়। কোন কোন কর্মকর্তা এসব পাসপোর্টে স্বাক্ষর করেছেন, কারা সিল মেরেছেন, কার নির্দেশে তা তৈরি হয়েছে—এসব যাচাই-বাছাই করা হয়। তদন্ত শেষে ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে চিহ্নিত করে অধিদপ্তর। তাঁরা হলেন পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম, সহকারী পরিচালক এস এম শাহজাহান, উচ্চমান সহকারী মো. শাহজাহান মিয়া এবং মো. সাইফুল ইসলাম। এই চারজনকেই মিথ্যা তথ্য ও জাল অনাপত্তি সনদ দেখিয়ে সরকারি কর্মকর্তা নন এমন নাগরিকদের ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ দেওয়ার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভাগীয় তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে সহকারী পরিচালক এস এম শাহজাহান এখন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট প্রদানে সহায়তার জন্য সৌদি আরবে আছেন।
বরখাস্তের আদেশ দেওয়া চিঠিতে পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলেছে, প্রাপ্যতাবিহীন ব্যক্তিদের ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ দেওয়ায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। যাঁরা সরকারি কর্মকর্তা সেজে ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ নিয়ে তুরস্কে গিয়েছেন, তাঁদের পাসপোর্ট আবেদনপত্র যাচাই করে দেখা গেছে যে আবেদন গ্রহণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই পাসপোর্টের আবেদনপত্র গ্রহণ ও ইস্যু প্রক্রিয়ায় জড়িত থেকে কর্মকর্তারা কর্তব্যে অবহেলা ও গুরুতর অসদাচরণ করেছেন।
জানতে চাইলে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এন এম জিয়াউল আলম বলেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এমন ঘটনা এর আগে কখনো শুনিনি। তাই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে আমরা যাঁদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছি, তাঁদের বরখাস্ত করেছি। এই সঙ্গে একজন পরিচালকের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির তদন্ত শেষ হলে এভাবে সরকারি কর্মকর্তা সেজে ও সরকারি আদেশ নিয়ে কতজন বিদেশে গেছেন, তা পুরোপুরি বলা যাবে।’
তবে পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে সরকারি কর্মকর্তা সেজে বিদেশে যাওয়া শতাধিক ব্যক্তির নাম বের হয়ে আসতে পারে। আর এগুলো তো হঠাৎ করে হচ্ছে না, অনেক দিন ধরেই চলছে। তেমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, যাঁরা এভাবে বিদেশে গেছেন, তাঁরা জঙ্গি বা অন্য যেকোনো দলের বা গোষ্ঠীর লোক হতে পারেন। আবার সাধারণ কেউও হতে পারেন।