পরিবহন ধর্মঘট ডাকতে অজুহাতের অভাব নেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাস মালিক ও শ্রমিকদের। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের দাবিও আদায় করছেন। মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে অনেক সময় পুলিশ-প্রশাসনকে মালিক-শ্রমিকদের অন্যায় দাবি মেনে নিতে হচ্ছে।
ফরিদপুরের মধুখালীতে সোহাগ পরিবহনের একটি বাসে ডাকাতির ঘটনার পর ওই বাসের চালক, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজারকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৯ মে থেকে এই অঞ্চলে পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।
খুলনা রেঞ্জের পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এই বিভাগের আন্তজেলা-উপজেলার কোনো না কোনো পথে বাস ধর্মঘট লেগেই থাকে। তবে সংঘবদ্ধভাবে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে গত পাঁচ বছরে চারবার বড় ধরনের ধর্মঘট হয়েছে। সরকারের বিআরটিসি বাস চলাচলের কারণে তাদের আয় কমার কারণ দেখিয়েও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাসমালিক ও শ্রমিকদের ধর্মঘট ডাকার নজির আছে। তাদের দাবির কারণে এই অঞ্চলের লাভজনক অন্তত আটটি পথে বিআরটিসি বাস চলাচল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
তা ছাড়া কোনো অভিযোগে মালিক বা শ্রমিক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, মহাসড়কে নসিমন-করিমন চলাচল বন্ধ, টার্মিনালে শ্রমিকদের চাঁদাবাজি বন্ধের প্রতিবাদ, বাসের ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এই অঞ্চলের বাসমালিক ও শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডেকে চলছেন। এমনকি শ্রমিক সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের পর বাস ও পরিবহন ধর্মঘটও ডাকা হচ্ছে। আবার এই সংঘর্ষের কারণে কেউ গ্রেপ্তারের পর তাদের মুক্তির দাবিতেও ধর্মঘট ডাকা হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার পর বাসচালক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদেও ধর্মঘট ডাকে শ্রমিকেরা।
পুলিশের খুলনা রেঞ্জের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাসমালিক ও শ্রমিকদের ধর্মঘট ডাকার জন্য কোনো কারণ লাগে না। এদের আচরণ এমন যে এরাই এখানকার সরকার। কোনো সমস্যা হলে তারাই সমাধান করবে। পুলিশ বা প্রশাসন কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘আন্তজেলা বাসমালিকদের একটি বড় অংশই আগে পরিবহন শ্রমিক ছিল, এখন মালিক হয়েছে। তাই কে মালিক আর কে শ্রমিক আলাদা করা যায় না। সবার ব্যবহারই প্রায় একই রকম। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা মালিক-শ্রমিকদের যারা নেতৃত্ব দেয় তারা সব সময় সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা হয়। ফলে মালিক-শ্রমিকেরা দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।’
চলতি মাসের গত সপ্তাহে যশোর-বেনাপোল সড়কে বাস ধর্মঘট ডাকা হয়। এর কারণ—একজন শ্রমিক নেতাসহ কয়েকজনকে বেনাপোল বন্দর থানা-পুলিশের গ্রেপ্তার করা। অথচ এই ঘটনার সঙ্গে বাস বা পরিবহন চলাচলের কোনো সম্পর্কই ছিল না। মাদক চোরাচালান-সম্পর্কিত একটি ঘটনায় এদের গ্রেপ্তার করা হয়।
মালিক-শ্রমিকেরা ধর্মঘটে যে শুধু নিজেদের পরিবহনই বন্ধ রাখছে তা নয়, সাধারণ মানুষের বিকল্প যানবাহনের চলাচলেও বাধা সৃষ্টি করে। ধর্মঘটের সময় ভ্যান, নসিমন, করিমন, মাইক্রোবাসে এলাকার লোকজন চলাচল করেন। শ্রমিকেরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে এ ধরনের যানবাহন চলাচলেও বাধা সৃষ্টি করে। এবারের ধর্মঘটেও খুলনা থেকে বের হওয়ার দুটি অংশ এবং সোনাডাঙা-সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড, বাগেরহাটের কাটাখালী, যশোরের নিউমার্কেট মোড়ে অবস্থান নিয়ে এ ধরনের যানবাহনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। তবে মাওয়া হয়ে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিকই আছে। এই সড়ক দিয়ে বাগেরহাট ও খুলনাগামী বাস চলতে দেখা গেছে।
খুলনার সিটি কলেজের শিক্ষক শামীম হাসান বলেন, ‘এই অঞ্চলের মানুষ বাস মালিক-শ্রমিকদের কাছে একেবারেই জিম্মি। এরা ইচ্ছামতো নিয়ম বানায়। ভাড়া বাড়ায়। কোনো রুটে গেটলক সার্ভিস নেই। অথচ ভাড়া নেওয়া হয় গেটলক সার্ভিসের। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাঁকে মারধর করা হয়। গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়।’
তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের খুলনা শাখার সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সী হোসেন আলী বলেন, ‘শ্রমিকদের নানা ভাবে হয়রানি করা হয়। ডাকাতির ঘটনা, অথচ বাসের শ্রমিকদেরও আসামি করা হচ্ছে। কিন্তু সড়কের নিরাপত্তা পুলিশ দিতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদ না করে উপায় নাই। এত প্রতিবাদের পরও তাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না।’
আরও খবর