আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারি নিয়ে এবারের মতো এতটা অনিশ্চয়তা ও রহস্যময়তা সম্ভবত এর আগে সৃষ্টি হয়নি। ডেমোক্র্যাট শিবিরে মনোনয়ন দৌড়ে বেশ খানিকটা ব্যবধানে সামনে রয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু তিনি কোনো চ্যালেঞ্জ ব্যতিরেকে ডেমোক্র্যাট মনোনয়ন পেয়ে যাবেন বলে যে ধারণা এক সময় করা হয়েছিল, তা এখন আর নেই। ২৯ মার্চ এ প্রতিবেদন লেখার সময় হিলারি ক্লিনটন ডেমোক্র্যাট মনোনয়নের জন্য ২৩৮৩ ডেলিগেট ও সুপার ডেলিগেটের সমর্থন লাভের দৌড়ে ১৭১২ জনের সমর্থন নিশ্চিত করেছেন। প্রাইমারিতে দুই হাজার ৪৯ জন ডেলিগেটের নির্বাচন বাকি রয়েছে। তাদের মধ্য থেকে বাকি ৬৭১ জন ডেলিগেটের সমর্থন পাওয়া কঠিন হয়তো হবে না। কিন্তু শেষের তিনটি প্রাইমারি নির্বাচনে ভালো ব্যবধানে বার্নি স্যান্ডার্সের জয়ী হওয়ার কারণে বেশ খানিক উদ্বেগের সৃষ্টি হয় হিলারি শিবিরে। তবে ক্যালিফোর্নিয়া, পেনসিলভেনিয়া ও নিউ ইয়র্কের মতো বৃহৎ স্টেটে হিলারি স্যান্ডার্সের তুলনায় ভালো ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
নিউ ইয়র্কের ২৪৭টি এবং পেনসিলভেনিয়ার ১৮৯টি ডেলিগেট আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৯ ও ২৬ এপ্রিল। ক্যালিফোর্নিয়ায় নির্বাচন হবে জুন মাসে। সেখানে আসন রয়েছে ৪৭৫টি। এসব স্টেটে বিপুল ব্যবধানে হিলারি জয়ী হতে পারেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় হিলারি ৪৭ শতাংশ এবং স্যান্ডার্স ৩৬ শতাংশ ভোট পাবেন বলে জনমত জরিপে বলা হয়েছে। অতএব যেসব স্টেটে আগামী মাসে প্রাইমারি বাকি রয়েছে, সেখানে বেশি ব্যবধানে হিলারি জয়ী হলে স্যান্ডার্স সরেও দাঁড়াতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে ইহুদি ধর্মমতের বিশ্বাসী স্যান্ডার্স নিজেকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করেন। তিনি হিলারির সাথে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও সুপার ডেলিগেটের সমর্থন পাচ্ছেন না।
স্যান্ডার্স যদি ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়ন পান এবং প্রেসিডেন্ট হন তাহলে তিনিই হবেন প্রথম ইহুদি, যিনি ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হবেন। আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি হবেন প্রথম ইহুদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। হিলারিও একইভাবে রেকর্ড করবেন। তিনি হবেন প্রথম ডেমোক্র্যাট দলের নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এবং প্রেসিডেন্ট হলে তিনি হবেন প্রথম নারী আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। অলৌকিক কিছু না ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রে শেষোক্ত রেকর্ডটি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
রিপাবলিকান শিবিরে প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন নিয়ে রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড ঘটে চলেছে। রিপাবলিকান ফেডারেল বা স্টেট কোনো পর্যায়ের আইনসভা সদস্য অথবা গভর্নর বা জেনারেলের পদ ছাড়াই ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের প্রধান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তার পরিচয় তিনি ক্যাসিনো, ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা ও আবাসন কোম্পানির বিলিয়নিয়ার মালিক। দলের প্রভাবশালী নেতাদের কেউই তাকে নিয়ে স্বস্তি অনুভব করছেন না। তবু তিনি রিপাবলিকান প্রাইমারিতে ৭৩৯ ভোট পেয়ে স্বস্তিকর অবস্থায় চলে গেছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রুজ এ পর্যন্ত পেয়েছেন ৪৬৫টি ডেলিগেট। ট্রাম্পকে মনোনয়নযুদ্ধে জয়ী হতে হলে ১২৩৭ ডেলিগেটের সমর্থন প্রয়োজন হবে। ডেলিগেট ভোট বাকি রয়েছে ৯৪৪টি। কাসিক ১৪৩টি ভোট পেলেও এখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াননি। তিনি সরে দাঁড়ালে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ট্রাম্প ও ক্রুজের মধ্যে। ইতোমধ্যে জেব বুশ ট্রাম্পকে ঠেকাতে ক্রুজের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউ ইয়র্ক উভয় স্থানে ট্রাম্প জয়ী হবেন বলে জনমত জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। বেলজিয়ামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে প্রান্তিকতা বেশ বাড়ছে। ফলে যতই চেষ্টা হোক না কেন ট্রাম্পকে পেছনে ফেলা কঠিন হতে পারে।
তবে প্রতিযোগিতায় সামনে থাকলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডেলিগেটের সমর্থন ট্রাম্প পাবেন কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সে ক্ষেত্রে তাকে মনোনয়ন না দিয়ে সমঝোতার কোনো প্রার্থীকে সামনে নিয়ে আসা হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প হুমকি দিয়ে রেখেছেন জয়ী হওয়ার পরও তাকে মনোনয়ন দেয়া না হলে ভোটারদের মধ্যে দাঙ্গা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। আবার ট্রাম্প মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও রিপাবলিকান শিবিরের জন্য বিপদ ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাম্পের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে বিভিন্ন জনমত জরিপে। এরপরও ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে রুখতে পারবেন কি না তা নিয়ে চলছে রিপাবলিকান শিবিরে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা।
অবশ্য আমেরিকান নির্বাচনে প্রধান দুই দলের প্রার্থী কে হতে পারবেন তা অনেক ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। এসব নির্র্ণায়কের মধ্যে অর্থ-বিত্তের জোগান, মিডিয়া সমর্থন, আইপ্যাকসহ দাপটশালী গ্রুপগুলোর ইচ্ছা- সর্বোপরি বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলো কাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেখতে চাইছেন তার ওপর নির্ভর করে।
বারাক ওবামার গত ৮ বছরের মেয়াদটিকে অনেকে মনে করেছিলেন বর্ণহীন সময় হিসেবে পেরিয়ে যাবে। এর আগে জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাক ও আফগানিস্তানে দু’টি বড় যুদ্ধ করে দুনিয়াব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিলেন। ওবামা নির্বাচনের আগে সেই যুদ্ধ থেকে আমেরিকানদের সরিয়ে নিয়ে আসার অঙ্গীকার করেছিলেন। ওবামা এর অংশ হিসেবে ইরাক থেকে সেনা মোটামুটি প্রত্যাহার করেছেন। আফগানিস্তান থেকেও প্রত্যাহারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু ওবামা তার সময়ে মধ্যপ্রাচ্যকে সবচেয়ে বেশি অস্থির করে রেখেছেন। যুদ্ধটা আমেরিকানদের দিয়ে না করিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে এমনভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছেন যে আমেরিকান গেম এখন অনেকটা তারাই খেলে দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মানচিত্র পরিবর্তনের অ্যাজেন্ডা অত্যন্ত সুচারুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হয় বারাক ওবামা।
তার এই অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য হিলারি ক্লিনটনের মতো প্রেসিডেন্টের প্রয়োজন অনুভব করতে পারেন বিশ্ব নিয়ন্ত্রকরা। এর পরও কোনো কারণে ট্রাম্পের মতো কেউ এবারে প্রেসিডেন্ট দৈবক্রমে হয়ে গেলে আমেরিকান লক্ষ্য শান্তিপূর্ণভাবে অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। এসব বিবেচনা আমেরিকানদের মধ্যে বেশ সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান থাকে। এর পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলার সময় আসেনি। তবে আগামী মেয়াদে যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন না কেন তাকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।