ইলিশ খেয়ে বছর শুরুর সংস্কৃতি বাঙালির না হলেও সে রেওয়াজই চালু করেছেন এক শ্রেণির ‘বাঙালি’। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বছরের সার্বজনিন উৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’ এবারও আর্থিক ভেদাভেদ প্রদর্শনের উপলক্ষ্য, সামর্থ্যের উপহাস হয়ে দেখা দিচ্ছে।
প্রতিবছর দিনটি এলে উচ্চবিত্ত ও নব্যধনীদের দাপটে চুপসে যান সাধারণ সামর্থ্যের মানুষেরা। অন্তরে বাঙালিয়ানা নিয়েও কেবল ইলিশ কেনার সামর্থ্য না থাকায় পরিবারের সামনে মুখটা অন্ধকার হয়ে যায় উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির।
এত গেল ভোক্তার কষ্ট, অন্যদিকে বেচারা ইলিশও কম অসহায় নয়।
পহেলা বৈশাখ তাদের কাছে এখন অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। এ উপলক্ষে নির্বংশ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় অমূল্য নিরীহ ইলিশের।
প্রিয় ইলিশকে হারিয়ে যেতে দিতে নেই বলেই মাস দু’য়েক এ মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। অভয়ারণ্যে বংশবিস্তারের সুযোগ করে দিয়ে সারা বছরের ইলিশ ঘাটতি দূর করাই উদ্দেশ্য। কিন্তু চোরে কেন ধর্মের কাহিনী শুনতে যাবে?
তাইতো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে- লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু সংখ্যক তাজা ইলিশ এখনো বাজারে আসছে।
অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে মঙ্গলবার (০৫ এপ্রিল) মধ্যরাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গেলে বিষয়টি হালকাচালে স্বীকার করেন একাধিক বিক্রেতা।
তাদের একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, ইলিশ ধরা বন্ধ থাকলেও মাঝে মাঝে ভোলা, চাঁদপুর, বরিশালের ইলিশ চলে আসে। সামনে বৈশাখ বলে এখন ইলিশের চড়া দাম।
বাজারে ময়মনসিংহের কালা মিয়ার আড়তে কাজ করেন কর্মী মো. জীবন।
তিনি বলেন, কারওয়ান বাজারের আড়তে ইলিশ আসে ভোরে। সারারাত আসে অন্য মাছ।
যারা আগেই বিপুল সংখ্যক ইলিশ কিনে স্টোরে রেখেছেন, তাদের এখন খুব সুসময়- বলে জানান জীবন। জানালেন, ইলিশ বিক্রেতারা এখন দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে বিক্রি করছেন প্রতি পিস। এ দাম আরও বাড়বে বলেও বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে জানান তিনি।
এ কর্মীও বলেন, মাঝে মাঝে নতুন ধরা ইলিশ বাজারে আসে, তবে গোপনে, গোপনেই সেগুলো বিক্রি হয়।
আড়ত থেকে এসব ইলিশ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে চলে যায়। এক সংগ্রহকারীর কাছ থেকে কেনেন অন্য সংগ্রহকারী। এভাবে এহাত-ওহাত করে মাছগুলোর দাম কেবলই বাড়ে।
মাঝরাতে একের পর এক ট্রাক এসে থামছে সোনারগাঁও হোটেলের উল্টোদিকের রাস্তায়। প্রাণচঞ্চল কর্মীরা বাক্স ধরে নামাচ্ছেন, আড়তে জড়ো করছেন।
এক ট্রাক চালকের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তিনি সাতক্ষীরা থেকে এসেছেন। চারপদের মাছ এসেছে তার ট্রাকে।
সকালে ইলিশ বিক্রি করবেন, এমন এক ব্যবসায়ী বলেন, সারাবছরে এ সময়টাতে লাভ একটু বেশি। মনে করেন যে, মাছ ধইরা রাখা অইসে না এতদিন? একটু ব্যবসাতো করতেই অয়।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরা বা সেগুলো ঢাকার বাজারে বিক্রির বিষয়টি জানেন না বলে তার দাবি।
এ ব্যবসায়ী বলেন, আমার তো পর্যাপ্ত মাছ আছে। আমি আর অবৈধ উপায়ে মাছ আই না কী করুম? খালি খালি ঝামেলা কইরা তো লাভ নাই।
তিনি জানান, কিছুদিন আগেও ছোট ইলিশের হালি বিক্রি করেছেন ১৬শ থেকে ২২শ টাকায়। কিন্তু এখন সে মাছগুলোর প্রতি পিসই বিক্রি করছেন এ চেয়ে বেশি দামে।
এখন যারা কিনছেন, তারা বেশিরভাগই বেশ সামর্থ্যবান বলে জানান এ বিক্রেতা।
এর আগে মৎস্য বিভাগ জাটকা ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ডিম রক্ষায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অভয়াশ্রমে সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
অভয়াশ্রমের আওতায় রয়েছে- চাঁদপুরের ষাটনল-লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১০০কিলোমিটার, ভেদুরিয়া-চর রুস্তমের ১৫০ কিলোমিটার, তেঁতুলিয়া নদী ও চরইলিশা-চরপিয়ালের ৯০ কিলোমিটার, ভেদরগঞ্জ-চাঁদপুরের মতলব পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকা।
তবে মার্চ থেকেই ইলিশের দাম চড়তে শুরু করে। পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রতিদিন ইলিশের বাড়ন্ত দাম নিয়ে প্রতিবেদন হয়। সেসব দেখে আরও বেশি হাহাকার করেন কম সামর্থের মানুষেরা।
মোবাইল ফোনালাপে এক পাঠিকা জানান, ১৪ হাজার টাকা আয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার চালান। বৈশাখকে কেন্দ্র করে এক পিস ইলিশ কিনে রেখেছেন সাড়ে ১৪শ টাকায়। সেদিনের অন্য খরচতো এখনো বাকি।
‘সরকারি চাকরিজীবিরা এদিনের বোনাস পাবে বলে সান্ত্বনা আছে। কিন্তু আমরা যারা সীমিত আয়ে টেনেটুনে সংসার চালাই, তারা সন্তানের ইলিশের আব্দার কীভাবে মেটাই? পহেলা বৈশাখে ইলিশ কেন টানেন আপনারা? এত নিউজ আর ফিচার কেন ইলিশ নিয়ে? টিভি খুললেই ইলিশ রান্নার রেসিপি! তাহলে তো উৎসবটা বড়লোকেরই হয়ে গেল’- বলেন এ ক্ষুব্ধ মা।
এসব চিন্তা করেই হয়তো সরকারি সংশ্লিষ্টরা ও সংস্কৃতি প্রতিনিধিরা এবার ইলিশ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
তারা বলছেন, সাধারণ মানুষ ও ইলিশের স্বার্থে এ দিনটির সঙ্গে ইলিশকে অঙ্গাঙ্গি করবেন না। উৎসবটি সবার জন্যই উপভোগ্য হোক, আর ইলিশও রক্ষা পাক- এটাই চাইছেন তারা।