বারবার হোঁচট খেয়েও হাল ছাড়িনি: বিমান চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন

Biman_Chairman_Jamal_Uddin-01এভিয়েশন নিউজ: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পদটিতে দায়িত্ব পালনের ছয় বছরের দীর্ঘ পথ চলায় তিনি বারবার হোঁচট খেয়েছেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের কর্মকর্তাদের আটক করার পর তাকে জড়িয়ে যেসব বক্তব্য সামনে এসেছে সেগুলো উড়িয়ে দেন বিমানবাহিনীর সাবেক এই প্রধান। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কেউ কখনোই কোনো দুর্নীতি কিংবা দুর্নীতির সঙ্গে যোগসাজশের প্রমাণ হাজির করতে পারে নি, পারবেও না।

মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস-এ নিজ বাসভবনে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন জামাল উদ্দিন আহমেদ। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি জানান বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের ভেতর-বাহিরের অনেক অজানা কথা।

জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ক’টি মাস ধরে বিমান লাভজনক হয়ে উঠছে। অনেক ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করে বিমানে সাবলীলতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে হজ ফ্লাইট চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে ১৮৫ কোটি টাকা। অর্জনের ঠিক এমনই একটি সময়ে পাইলট, কেবিন ক্রু আর কর্মকর্তাদের স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়া বিমানকে আবারও পিছিয়ে দেবে।

অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হলে সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের যথাযথ সাজা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিমান চেয়ারম্যান হিসেবে তার দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান জামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বিমানের একেকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী উন্নত পে-স্কেলে বেতন ভাতা পান, তাদের চোরাচালানে জড়িত হওয়া নিতান্তই গর্হিত অপরাধ।

চোরাচালানের এই ঘটনায় বিমান চেয়ারম্যানকে জড়িয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে সে-প্রসঙ্গে ‍জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি জানি এ-অপমান আমাকে সইতে হবে। কিন্তু আমি এতে মোটেই বিচলিত নই। দীর্ঘ ছয় বছরের পথ চলায় অনেকবার হোঁচট খেতে হয়েছে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। এবারও ছাড়বো না।

Biman_Chairman_Jamal_Uddin-02

মিগ-টোয়েন্টি নাইন দুর্নীতি মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাকে আসামি করা হয়েছিলো, তখনও নানাভাবে অপদস্থ হতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো দুর্নীতিরই প্রমাণ মেলে নি। রাষ্ট্রের স্বার্থে সে-কাজ করেছি, ফলে ব্যক্তিগত সেই সমস্যাকে কখনোই বড় করে দেখিনি, বলেন জামাল উদ্দিন আহমেদ।

তিনি আরও বলেন, একজন বিমানবাহিনী প্রধান হিসেবে অবসরে যাওয়ার পর আমাকে স্রেফ একটি ঘড়ি ছিনতাইয়ের মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়েছে, এর চেয়ে বড় অপমান আর কিই বা হতে পারে। সে-অপমান যখন সইতে পেরেছি, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অপবাদও সইতে পারবো।

তিনি বলেন, পরে সত্যের জয় হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে এসব মামলার একটিও টেকেনি। এসব অভিযোগও টিকবে না।

জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বিশ্বাস করে আস্থা রেখে একটি গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি সে-দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। আমি সে আস্থার প্রতি সম্মান রেখে যতক্ষণ সম্ভব কাজ করে যাবো।’

এক সময়ে বিমানবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তা, যুদ্ধবিমান উড্ডয়নে পাকা বৈমানিক জামাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, বাহিনীতে একজন মেধাবী সৈনিক ছিলাম। আমার জীবনে হার মেনে নেওয়ার কোনোও রেকর্ড নেই। আর সে দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।

ছয় বছরে বিমানে তার হাতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে সেসবেরও একটি চিত্র বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠানটির এই শীর্ষ ব্যক্তি। তিনি বলেন, নিজস্ব ফ্লাইট দিয়ে হজযাত্রী আনা-নেওয়া করে বিমান এ-বছর সুনাম কুড়িয়েছে। বিমানের এখন ৪টি নতুন বোয়িং ৭৭৭ রয়েছে। শিগগিরই আরও দুটি আসছে। একেকটি বোয়িং ৭৭৭ কেনা হয়েছে ১৭৫ মিলিয়ন ডলারে।এটি অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত যা এই সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

এফ-২৮ উড়োজাহাজ দিয়ে বিমানের ফ্লাইট পরিচালনার শেষ দিকে ভয়াবহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করে জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আমাদের যাত্রীদের কোনোভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণে বাধ্য করতে পারি না।

তিনি বলেন, শুনেছি সে সময় পাইলটরা ‘শেষ কলেমা’ পড়ে উড়োজাহাজ চালাতে উঠতেন। এমন একটি কথা আমাকে আলোড়িত করে। এবং বিষয়টি সরকারকে অবহিত করলে নতুন বোয়িং ৭৭৭ কেনার সিদ্ধান্ত হয়।

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিমানের সংস্কারে যে উদ্যোগই নিতে গেছেন সেখানেই হোঁচট খেয়েছেন, বাধা এসেছে। এর মধ্যেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিমান উপকৃত হয়েছে, সরকার উপকৃত হয়েছে, জানালেন জামাল উদ্দিন আহমেদ।

এর অন্যতম হচ্ছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া রুটে ফ্লাইট শিডিউল পরিবর্তন। বিমান চেয়ারম্যান বলেন, স্রেফ শিডিউল পরিবর্তন করেই এই দুই রুটে বছরে ৮ কোটি টাকা ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে দুর্নীতি ও অদক্ষতা এমনভাবে বাসা বেঁধে আছে যা সরাতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন।

বিমানের সাধারণ কর্মী থেকে সর্বোচ্চ কর্মকর্তার মধ্যে কেবলই একটা ‘খাই-খাই’ ভাব লক্ষ্য করি। অথচ একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে তাদের কিছুটা উদার মনোভাব থাকা প্রয়োজন। যার অভাব এখানে রয়েছে। ‘খাই খাই’ বাদ দিয়ে তাদের মধ্যে ‘দেই দেই’ মনোভাব থাকলেই বিমানকে বাঁচানো সম্ভব হবে, বলেন জামাল উদ্দিন আহমেদ।

Biman_Chairman_Jamal_Uddin-03

আগে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া রুটে চার ঘণ্টার ফ্লাইট পরিচালনা করে পাইলট, কেবিন ক্রুরা ৩৬ ঘণ্টার বিশ্রাম নিতেন। এতে সিঙ্গাপুর রুটে বছরে অতিরিক্ত পাঁচ কোটি টাকা আর মালয়েশিয়ায় তিন কোটি টাকা বাড়তি খরচ হতো। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শিডিউল পাল্টানোর জন্য দেনদরবার করে তা নিশ্চিত করেন জামাল উদ্দিন আহমেদ।

এছাড়াও অভ্যন্তরীণ রুটে সিলেটের যাত্রীদের জন্য উত্তরা রেস্ট হাউস ও হোটেলগুলোতে যে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বছরে খরচ হতো সেটাও স্রেফ অনিয়ম ও অবহেলার কারণেই হতো। একক ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে উত্তরা রেস্ট হাউজে যাত্রীদের রাত্রিযাপন বন্ধ করা হয়। শিডিউলে পরিবর্তন এনে যাত্রীদের সহজে তাদের গন্তব্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

এছাড়াও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে অফিসে ঢোকা ও বের হওয়া, ইউনিফর্ম পরে অফিস করা এমন বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কিন্তু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণেই বিমানে তিনি অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। আর সে কারণেই একটি চক্র তার ইমেজ খারাপ করার লক্ষ্যে নানা ধরনের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তা সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, দাবি জামাল উদ্দিন আহমেদের।

লাগেজ কাটা বিমানের একটি বড় ধরনের অপবাদ। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেও এখানে কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নি। লাগেজ হোল্ডারে নিয়মিতদের নিযুক্ত না করে ক্যাজুয়াল শ্রমিক নিয়োগ ও তাদের পকেটবিহীন ইউনিফর্ম পরা নিশ্চিত করা এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না দেবার যে পরিকল্পনা তিনি দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।একজন হতাশ জামাল উদ্দিন আহমেদ।

তবে পরিস্থিতি আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো। বিমান আয়ের মুখ দেখতে শুরু করেছে। নতুন ঝকঝকে বোয়িং ৭৭৭ এসেছে, আরও আসছে। সিবিএ’র সঙ্গে যেসব ঝামেলা ছিলো সেসব বিষয়ে নেতারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। বিমানের কর্মীদের মধ্যে ভালোভাবে কাজ করার মানসিকতা ফিরে আসছে। এ-অবস্থা চলতে থাকলে বিমান এগিয়ে যাবে।

দীর্ঘ আলাপচারিতায় জামাল উদ্দিন আহমেদ নির্বিঘ্নে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কিছু রাজনৈতিক চাপের কথাও উল্লেখ করেন। রাঘব বোয়ালদের চাপে সামান্য কেবিন ক্রুর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানাতে ভোলেননি তিনি।

মাহমুদ মেনন ও ইশতিয়াক হুসাইন, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.