অপরাধ বিভাগ ডেস্ক : পুরনো ঢাকার কিশোর গ্যাং লিডার রাকিবকে খুঁজছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন, মাদক বিক্রি, ফেসবুক হ্যাকিং, ছিনতাই, নারী নির্যাতন, ফেইক আইডি খুলে তরুণীদের ব্ল্যাকমেইল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে।
র্যাবের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, রাকিবের বিরুদ্ধ তারা একটি মেয়ের ফেইক ফেসবুক আইডি খুলে সেখানে ওই মেয়ের আজে বাজে ছবি দিয়ে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ পেয়েছেন। ইতিমধ্যে ওই আইডি থেকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কয়েকটি আজে বাজে নোংরা ছবি উদ্ধার করেছে। এই ঘটনায় মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও র্যাব সুত্রে জানাগেছে।
রাকিবের পুরো নাম রাকিবুল ইসলাম মিলু। পুরনো ঢাকারার ব্যবসায়ী মোখলেসুর রহমানের ছেলে রাকিব একজন মাদকাসক্ত এবং মাদক বিক্রেতা বলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পেরেছেন। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। গ্রামের লোকজন রাকিবকে একজন বখাটে ছেলে হিসাবে জানে এবং ভয়ে কেউ তার সঙ্গে মেলামেশা করে না।
অভিযোগ আছে, মাদকাসক্ত হয়ে সে পুরনো ঢাকার চানখার পুল অসংখ্য মানুষজনকে মারধরও করেছে। তার অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ট বলেও স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশেকে একাধিকবার অভিযোগ করেছেন। ছাত্র শিরিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ায় ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলে না। কথায় কথায় সে মেরে ফেলা ও হাত পায়ের রগ কেটে ফেলার হুমকী দেয় মানুষকে।
পুরনো ঢাকায় রাকিবের একটি কিশোর গ্যাং বাহিনী আছে। এই বাহিনীর সদস্যদের সবার মোটর সাইকেল আছে। বাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন টিএসসি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে মাদক ও গাঁজা সেবন করে। এরপর পার্কে বেড়াতে আসা প্রেমিক প্রেমিকা জুটিদের টার্গেট করে কখনো ব্ল্যাকমেইল, কখনো প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। তার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১১ জন।
ঢাকায় তার দুটি গ্যাং আস্তানা আছে। সেখানে তারা নানা ভাবে সুন্দরী মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করে নিয়ে গিয়ে ধর্ষন করে। এমনকি অস্ত্রের মুখে ধর্ষনের সেই ছবি হাসিমুখে তোলার জন্য মেয়েকে বাধ্য করে। এরপর ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েদের জিম্মি করে মাসের পর মাস নির্যাতন চালায়। যদি কোন মেয়ে তার কথা না শুনে তাহলে ওই মেয়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়।
সম্প্রতি এরকম একটি মেয়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে ওই মেয়ে ও তার পরিবারকে নানা ভাবে হয়রানি করছে রাকিক ও তার গ্যাংয়ের সদস্যরা। মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি রাকিবের বাবা মোখলেসুর রহমান ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে জানিয়েও কোন ফল পায়নি। উল্টো রাকিব মেয়েটিকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে এবং রাস্তা-ঘাটে পেলে খুন করে লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিবে বলেও হুমকি দিচ্ছে।
প্রতিদিন সে তার দুটি মোবাইল নম্বর ০১৭২৯৮৬১৬৮৬, ০১৭৮৮৮১০৬৭৬ মোবাইল নম্বরসহ অসংখ্য নম্বর থেকে ফোন করে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন মানুষজন এবং মেয়েটির কলেজের ছাত্রছাত্রী, বন্ধু-বান্ধবী ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে মেয়েটি সম্পর্কে নানা আজে বাজে কথা রটাচ্ছে। এই ফোন নম্বর থেকে সে মেয়েটিকে পতিতা, বেশ্যা, খানকি বলেও প্রতি নিয়ত মেসেস পাঠাচ্ছে।
জীবনের ভয়ে মেয়েটি গত ৬ মাস ধরে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। মেয়েটির পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুর এলাকায় কোচিং সেন্টারে কোচিং করতেন মেয়েটি। সেখানেও রাকিব দলবল নিয়ে হানা দিয়েছে। আতঙ্ক ও ভয়ে মেয়েটি মানষিকভাবে বিপর্যস্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানাগেছে।
এই অবস্থায় মেয়েটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রাকিবকে গ্রেফতারের দাবি জানান। অন্যথা সে আত্মহত্যা করে গোটা বিশ্বকে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাবেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ রাকিবকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলে আরো অসংখ্য মেয়ের করুণ কাহিনী ও মাদক সেবনকারী ও মাদক বিক্রেতাদের বিশাল আস্তানার সন্ধান বেরিয়ে আসবে।
এই প্রসঙ্গে একটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি তারা মৌখিক ভাবে জেনেছেন। বিষয়টি নিয়ে সাইবার ক্রাইম ইউনিট কাজ করছে বলেও তিনি জানান। প্রাথমিকভাবে তারা অভিযোগের বেশ কিছু সত্যতা পেয়েছেন। তবে এই ঘটনায় মেয়েটি কিংবা মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে কোন মামলা না হওয়ায় তারা এখনো অভিযানে যাচ্ছেন না। তবে রাকিব ও তার বাহিনীর প্রতিটি সদস্য তাদের নজরদারিতে আছে বলেও তিনি জানান।
তার মতে রাকিব ফেসবুকে মেয়েটির ফেইক আইডি খুলে যে অপরাধ করেছে সেটি ভয়ঙ্কর ও জগন্য অপরাধ। তিনি বলেণ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে এগুলো হবে অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, ফেসবুকে বা কোনো গণমাধ্যমে কাউকে নিয়ে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে। কাউকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হুমকি দিলে, অশালীন কোনো কিছু পাঠালে কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু করলে তা সাইবার অপরাধ হবে। আবার ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে কিংবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলে সাইবার অপরাধ হতে পারে। এ ছাড়া অনলাইনে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তা-ও সাইবার অপরাধ।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের সচিব নারায়ন চন্দ্র সরকার বলে, কোনো কারণে কেউ যদি সাইবার অপরাধের শিকার হন, তাহলে নজরে আসা মাত্রই আপনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বিষয়টি অবগত করে রাখতে পারেন। প্রয়োজনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রাখতে পারেন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে লিখিতভাবে জানিয়ে রাখতে পারেন।
এতে করে কেউ আপনাকে মিথ্যাভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করলে আপনি কিছুটা সুরক্ষা পেতে পারেন। আপনি যদি সাইবার অপরাধের গুরুতর শিকার হন এবং প্রতিকার পেতে চান, তাহলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর আশ্রয় নিতে পারেন। এ আইনের আওতায় থানায় এজাহার দায়ের করতে পারেন। আপনার ওয়েবসাইট কেউ হ্যাক করলে, ফেসবুক বা অন্য যেকোনো মাধ্যম হ্যাক হলে এবং আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কেউ চুরি করলে কিংবা অন্য কোনো অপরাধের শিকার হলে দেরি না করে কাছের থানায় জানিয়ে রাখা উচিত। যদি সাইবার অপরাধের অভিযোগে মিথ্যাভাবে ফেঁসে যান, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বুঝিয়ে বলতে হবে যে আপনি পরিস্থিতির শিকার।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল কোন মাধ্যমে কেউ মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও বা কারো মেজেঞ্জার বা ফেসবুকে কিংবা মোবাইলের ফটো গ্যালারিতে এধরনের কোন ছবি পাওয়া গেলে তা সাইবার অপরাধ হতে পারে।
তিনি বলেন, অনলাইন ব্যবহারে সাবধান বা সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নেই। একটু অসচেতন হলেই ফেঁসে যেতে পারেন সাইবার অপরাধের দায়ে। জেনে হোক বা না জেনে, আপনি যদি অনলাইনে কোনো অপরাধ করেই ফেলেন, তাহলে এর জন্য দিতে হবে কঠিন মাশুল। সাইবার অপরাধীর বিচারে দেশে কঠিন আইন রয়েছে। যদিও আইনটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু যে আইন বিদ্যমান, তার প্রয়োগও বিদ্যমান। আর এ আইনের নাম হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)।