এভিয়েশন নিউজ: হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ ৩টি বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডেলিং কার্যক্রম জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাচ্ছে। বাকি দুটি হচ্ছে- চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। জয়েন্ট ভেঞ্চারের কাজ বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হবে। এ লক্ষ্যে আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) আহ্বান করেছে বিমান। আগ্রহী কোম্পানিগুলো আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে বিমানের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করতে পারবে।
এই কনসালটেন্ট কোম্পানির কাজ হবে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং জয়েন্ট ভেঞ্চার করতে একটি গাইডলাইন তৈরি ও দুপক্ষের জন্য দর নির্ধারণ করা। সে সঙ্গে আরএফপি নীতিমালা তৈরি, ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নির্ধারণ, অপারেটিং সিস্টেম তৈরি, দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি, সংশ্লিষ্টদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের দিকনির্দেশনা তৈরি করাও তাদের কাজের আওতায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেতে আগ্রহী কোম্পানিগুলোকে এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে গ্র“প সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের ওপর দক্ষতা, বড় বিমানবন্দরে হ্যান্ডেলিং, ইউরোপ, নর্থ আমেরিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এর আগে গত বছর বিমান কর্তৃপক্ষ শাহজালালের কার্গো ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং জয়েন্ট ভেঞ্চারে করার জন্য সরাসরি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছিল। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সুইসপোর্টসহ বিশ্বের ৫টি গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। কিন্তু বিমানের দরপত্র যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে মাত্র ৩টি দরপত্র গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। সেগুলো ছিল সুইসপোর্ট, দুবাইভিত্তিক ডানাটা ও তুরস্কভিত্তিক কোম্পানি সিভেলি। কিন্তু বিমানে এ ধরনের জয়েন্ট ভেঞ্চারভিত্তিক কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার মতো বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় ওই দরপত্র বাতিল করা হয়।
এরপরই বিমান পরিচালনা পর্ষদ একটি আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে অপর একটি সূত্র জানায়, বিমান জয়েন্ট ভেঞ্চারের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করার পর দুবাইভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে সম্প্রতি লাইসেন্স খোয়ানো একটি দেশীয় এয়ারলাইন্স একীভূত হয়ে গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ পাওয়ার জন্য ওঠেপড়ে লাগে।
একই সঙ্গে সুইসপোর্ট কোম্পানিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়ে শাহজালালের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা জানায়। প্রধানমন্ত্রী ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিমানের সিবিএ নেতাদের আন্দোলন ও সরকারদলীয় এক প্রভাবশালী এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীর (বর্তমানে এওসি নেই) হস্তক্ষেপে সেটি আর এগোয়নি। এ নিয়ে যুগান্তরে একটি বিশেষ প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এরপরই মূলত সরকার সে অবস্থান থেকে সরে আসে।
গত বছরের মাঝামাঝি কেভিন স্টিল বিমানের এমডি থাকাকালে গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডেলিং জয়েন্ট ভেঞ্চারে করার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছিলেন। জানা গেছে, ওই প্রভাবশালী এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীর সঙ্গে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডানাটার সুসস্পর্ক রয়েছে। তারাই ডানাটার স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। জানা গেছে, শ্রমিক লীগ-সমর্থিত বিমান সিবিএ ইতিমধ্যে বিমানকে জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাওয়ার বিষয়ে মৌন সমর্থন দিয়েছে। তাদের মতে, যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কাজে সম্মত থাকেন তাহলেই তারা সমর্থন দেবে।
তবে বিষয়টি চূড়ান্ত করার আগে বিমানের সব শ্রমিক সংগঠন, বাপা, বিওএ (বিমান অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন), কেভিন ক্রু অ্যাসোসিয়েশন, প্রকৌশল শাখার শ্রমিক সংগঠনের মতামত নেয়ার কথাও জানান তারা। বিমানের সাবেক এমডি ক্যাপ্টেন (অব.) মোসাদ্দিক আহম্মেদ জানান, বর্তমানে শাহজালালের যে অবস্থা তাতে শাহজালালের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডেলিং জয়েন্ট ভেঞ্চারে করা ছাড়া বিকল্প নেই। এটা সম্ভব হলে বিমান বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি আয় করতে পারবে। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের যে অভিযোগ রয়েছে তা দূর হবে। উন্নত যন্ত্রপাতি আনা হবে।
ম্যানুয়ালের পরিবর্তে সবকিছু ডিজিটালাইজড হয়ে যাবে। এতে শ্রমিকদের কষ্টও কমে যাবে। বর্তমানে শাহজালালের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের দুটি বিভাগের ঘাটে ঘাটে অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। হচ্ছে চুরি, লুটপাট আর চোরাচালান। সব মিলিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০০টি ফ্লাইট ওঠানামা করছে এ বিমানবন্দরে। এ অবস্থায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের।
সিভিল এভিয়েশন ও বিমানবন্দরের এ অবস্থা নিয়ে দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীরা আতংকিত ও হতাশ। তারা বলেছেন, এ ব্যবসায় মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছেন তারা। কিন্তু বিমানবন্দর ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়টি নিয়ে এ সেক্টরের বিনিয়োগকারীরা সরকারকে নানাভাবে অবহিত করলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
বর্তমানে নিখুঁত গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করার মতো আধুনিক ব্যবস্থা নেই বিমানের। যে কারণে যাত্রীদের লাগেজসহ অন্যান্য ব্যাগেজ পেতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ইমিগ্রেশন পদ্ধতিও আধুনিক না হওয়ায় যাত্রীদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রানওয়েতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই। অ্যাপ্রোচ লাইটের অবস্থা নাজুক। অর্ধেকই ঠিকমতো জ্বলে না। এয়ারফ্রেট কার্গো কমপ্লেক্স ও কার্গো ভিলেজ চুরি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্য। পণ্য ছাড়াতে ষাটঘাটে ঘুষ দিতে হয়। বাংলাদেশ বিমান, কুরিয়ার সার্ভিস আর কাস্টমসের একটি সিন্ডিকেট এ ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সাধারণ ব্যবসায়ীরা এর নাম দিয়েছেন ঘুষ চুরি আর দুর্নীতির বন্দর।
ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নেতারা বলেছেন, একটি পণ্য খালাস করতে বিমান ও কাস্টমসের প্রায় ৬০টি ঘাটে ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। আর প্রতি ঘাটে দিতে হয় মোটা অংকের টাকার ঘুষ। একটি সিন্ডিকেট কার্টন ভেঙে, পলিথিন খুলে হরহামেশা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার মূল্যবান পণ্যসামগ্রী। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি চুরি ও হারিয়ে যাওয়া মালামালের অভিযোগ বিমানের ক্লেম শাখায় ফাইলবন্দি হয়ে আছে।