পণ্য খালাস নিয়ে বিমান ও বেবিচকের তামাশা

scanning3_5257আমদানি করা কার্গো (পণ্য) খালাস নিয়ে সিভিল এভিয়েশন ও বাংলাদেশ বিমান তামাশা করছে। এ নিয়ে পুরো আমদানি সেকশনে তৈরি হয়েছে বিশৃংখল অবস্থা। হদিস নেই কয়েক হাজার টন মূল্যবান গার্মেন্ট এক্সেসরিজ ও মেশিনারিজের। গোডাউন, ওয়্যারহাউস, ক্যানোপি থেকে রানওয়ে- সর্বত্রই অগোছালো, স্থানে স্থানে রয়েছে মালামালের স্তূপ। দুই মাস আগে আসা অনেক পণ্যও ডেলিভারি দিতে পারছে না বিমান। এমনকি এর খোঁজও দিতে পারছে না।

কার্গো সেকশনের উন্নয়ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের নির্দেশও মানছে না সিভিল এভিয়েশন ও বিমান। সম্প্রতি কার্গো ভিলেজ পরিদর্শনে এসে তিনি বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের ওপর চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সিভিল এভিয়েশনের অসহযোগিতায় ক্ষুব্ধ বিজিএমইএ (বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) বাধ্য হয়ে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বিমানবন্দরে একটি শেড (গোডাউন) তৈরি করেছে। সেখানে শুধু গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, মেশিনারিজ ও অন্যান্য গার্মেন্ট পণ্য রাখা হবে। বুধবার বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ৮ হাজার স্কয়ার ফুটের এ শেডটি উদ্বোধন করেন। কাল শুক্রবার এসব অব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করবেন মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। তিনি আমদানি শাখা ও রানওয়েতে পড়ে থাকা মূল্যবান কার্গো পণ্যের অবস্থাও পরিদর্শন করবেন। এরপর বিষয়টি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো রফতানি ও আমদানি শাখার দীর্ঘদিনের সংকট নিরসনের জন্য বারবার তাগিদ দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। এমনকি কার্গো ভিলেজের ছাদ থেকে পানি পড়ার স্থান মেরামতও করে দিচ্ছে না তারা। বিমানের এ সংক্রান্ত আবেদন সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট শাখা (মেম্বার অপারেশন) বিভাগে পাঠালেও তা মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, মেম্বার অপারেশন এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্বান্ত দিতে পারছেন না। তার টেবিলে ফাইল গেলেই তা আটকে যায়। বেবিচকের চেয়ারম্যানের পর তার অবস্থান হলেও তিনি সার্বক্ষণিক সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। ফাইলে স্বাক্ষর করতে ভয় পান। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সৎ ও কর্মঠ হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও তিনি উন্নয়নবিমুখ। তার অসহযোগিতা ও ভয়ের কারণে দুই বছরে সিভিল এভিয়েশনের হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ ফেরত গেছে। দু’বছর ধরে বিমান কার্গো গোডাউনের র‌্যাকে পেলেট বসানোর তাগিদ দিয়ে এলেও তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেননি তিনি। তার ও সাবেক এক চেয়ারম্যানের অসহযোগিতার কারণে যুক্তরাজ্য বিমানের সরাসরি কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শাহজালালে বিনা টেন্ডারে নিয়োগ করতে হয় ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশী কোম্পানি রেডলাইনকে।

বিষয়টি সর্বশেষ মঙ্গলবার বিমান মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও বিমানের একাধিক কর্মকর্তার তোপের মুখে পড়েন এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান। গোডাউনের অব্যবস্থাপনার জন্য বৈঠকের সবাই মেম্বার অপারেশনকে দায়ী করেন। বৈঠকে বলা হয়, কার্গো গোডাউনের মালিক সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। তাদের কারণে কার্গো হাউসের সমস্যা দীর্ঘদিন জিইয়ে আছে। এতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানি প্রক্রিয়া। বিজিএমইএর অনেক মূল্যবান ডকুমেন্ট ও মালামাল সামগ্রী খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় নষ্ট হওয়ার পরও টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। বাধ্য হয়ে বিজিএমইএ নিজের টাকায় শেড নির্মাণ করেছে। এ শাখায় দক্ষ জনবল না থাকায় মালামাল গুছিয়ে রাখা যাচ্ছে না। যে কজন কর্মী আমদানি শাখায় কাজ করছে তাদের অধিকাংশই সব সময় মালামাল চুরি করায় ব্যস্ত থাকে। প্রতিদিন কোটি টাকার মালামাল চুরি যায়।

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান এসকেএফ বাংলাদেশ লিমিটেডের আমদানি করা ৭৬ হাজার ৯৫০ ডলার (প্রায় ৬২ লাখ টাকা) মূল্যের পণ্য কার্গো ভিলেজ থেকে হারিয়ে যায়। এসব পণ্য পরীক্ষা ও ডেলিভারির জন্য চাওয়া হলে কার্গো শাখায় কর্তব্যরত অফিসার ‘মালামাল পাওয়া যাচ্ছে না’ বলে জানান। এ বিষয়ে ২০ জানুয়ারি আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক, ২৫ জানুয়ারি আমদানি শাখার ব্যবস্থাপক এবং ৪ ফেব্রুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপকের কাছে আবেদন করেও পণ্য ফেরত পাওয়া যায়নি।

এক মাসে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে প্রায় ৫শ’ কার্টন পণ্য চুরি হয়। ২৫ মে কার্গো ফ্লাইটে আমদানি শাখায় আসে প্রায় ২১ রোল মূল্যবান গার্মেন্ট ফেব্রিক্স। যার এয়ার অ্যারো বিল নং-২৩২৬০৬৫৩৭২৫, ফ্লাইট নং-এমএইচ ৬২৪৬। এরপর থেকে পণ্যের হদিস নেই। একই সময়ে ১৮০ কেজি ওজনের এক বাক্স গার্মেন্ট মেশিনারিজও ঢাকায় আসে। যার এয়ারঅ্যারো বিল নং-১১২০৯২৫১২৪৪, ফ্লাইট সিকে-২৯৭। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এক মাসেও বিমানের আমদানি শাখার ম্যানেজার নাসির উদ্দিন তালুকদার মূল্যবান পণ্য দুটির হদিস বের করতে পারেননি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফ্লাইট নামার পর যারা কার্টন দুটি বিমান থেকে নামিয়েছে তাদের চিহ্নিত করা গেলেই পণ্য দুটির হদিস মিলবে। কিন্তু রেজিস্টার খাতায় নাম থাকলেও বুধবার পর্যন্ত তাদের খুঁজে বের করতে পারেনি ম্যানেজার (আমদানি)।

হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের পণ্য রাখার লোকেশনগুলো হচ্ছে ‘জিরো’, ‘ক্যানোপি-১’, ‘স্ট্রং রুম ১, ২’, ‘মেইন ওয়্যারহাউস-১, ২’। বিমানের ফ্লাইট অফিসারের দেয়া লোকেশন অনুযায়ী পণ্যগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার দায়িত্ব বিমানের লোডারদের। পণ্যের কাস্টমস ডিউটি দেয়ার পর পণ্যগুলো বুঝিয়ে দিতে হয়। তবে অনেক সময় বিমানের লোডাররা ইচ্ছে করে অন্য স্থানে পণ্যগুলো রেখে ‘পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না’ দাবি করে।
সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে অনেক পণ্য ‘খুঁজে না পেলেও’ টাকা দিলেই খোঁজ মেলে মুহূর্তেই। কোনো কোনো সময় মোটা অংকের টাকা আদায় করতে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষেও পণ্য অতিরিক্ত তিন-চার দিন আটকে রাখা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কাগজে-কলমে এসব পণ্য কার্গো গোডাউনে থরে থরে সাজানো থাকার কথা। কিন্তু ওয়্যারহাউসগুলোতে র‌্যাক থাকলেও র‌্যাকে পেলেট না থাকায় মালামাল রাখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে মালামালগুলো বিমানবন্দরে খোলা আকাশের নিচে অযত্নে অবহেলায় ফেলে রাখতে হচ্ছে।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, অহেতুক নানা কারণ দেখিয়ে পেলেটগুলো কেনায় বারবার বাধা দিচ্ছে সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার (অপস) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান। এক বছর আগে কার্গো ওয়্যার হাউস অটোমেশন করার জন্য শত কোটি টাকা দিয়ে যন্ত্রপাতি আনলেও সেগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ব্যবহার না থাকায় সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মালামালগুলো বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় হ্যান্ডলিং এজেন্ট ও বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের কর্মীরাও বলতে পারছে না পণ্যগুলোর অবস্থান।

বিমানের কার্গো শাখা সূত্রে জানা গেছে, কার্গো কমপ্লেক্সসহ পুরো এলাকার মালিক সিভিল এভিয়েশন (বেবিচক)। আগে কার্গো আউট ইয়ার্ডের আয়তন ছিল ১ হাজার ৭শ’ ফুট। বেবিচক কর্তৃপক্ষ এখান থেকে ১ হাজার ফুট নিয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ এয়ারক্রাফট পার্কিংয়ের জন্য। এখন কার্গো রাখার জন্য আউট ইয়ার্ডে মাত্র ৭০০ ফুট জায়গা আছে বিমানের। এ কারণে ২-৩টা ফ্লাইট নামলেই ভয়াবহ কার্গো জট দেখা দেয়।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.