সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত পাসপোর্ট

downloadদেশের সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হল পাসপোর্ট বিভাগ। এখানে সেবা নিতে গিয়ে ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার ও ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়। আর ঘুষ-দুর্নীতির দিক থেকে পাসপোর্টের পরেই রয়েছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শিক্ষা খাত।
বুধবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ-২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের অয়োজন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চ আয়ের তুলনায় নিু আয়ের মানুষের ওপর দুর্নীতি ও ঘুষের বোঝা অনেক বেশি। ২০১৫ সালে জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা ২০১২ সালের তুলনায় ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেবা খাতগুলোর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে পাসপোর্ট বিভাগ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলেও শহরাঞ্চলে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃংখলা বাহিনী। শহরাঞ্চলে এর পরে রয়েছে বিআরটিএ ও পাসপোর্ট বিভাগ। শহরাঞ্চলে সেবা পেতে সর্বাধিক ঘুষ দিতে হয় আইনশৃংখলা রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানার দাবি টাকা না দিলে তারা সেবা পান না। তবে ২০১২ সালের তুলনায় এবার (২০১৫) ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, এনজিও ও অন্যান্য খাতে দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার হার কমেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার, বিদ্যুৎ ও বীমা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে দুর্নীতি বেড়েছে। শিক্ষা, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর ও শুল্ক খাতে দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি এবং ৫৮ শতাংশ মানুষ ঘুষ লেনদেনের শিকার হয়েছেন। দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার হার ২০১২ সালে তুলনায় প্রায় সমান পর্যায়ে রয়েছে। তবে ঘুষের শিকার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। যা ২০১২ সালে ছিল ৫১ শতাংশ, এবার (২০১৫) হয়েছে ৫৮ শতাংশ। এবার শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পাসপোর্ট খাত। এর আগের জরিপে দুর্নীতির শীর্ষে ছিল আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থা।
তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে দেশের প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যাদের ওপর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। রাজনৈতিক দলগুলো কাগজে-কলমে দুর্নীতিবিরোধী যে কথাগুলো বলে, তা যদি বাস্তবে করে তাহলে দুর্নীতি কমে আসবে। তিনি জানান, সেবা খাতে রাজনৈতিক প্রভাব তুলে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। এখাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে দুর্নীতি বন্ধ সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে দুদকের ভূমিকাকে আরও কার্যকর করতে হবে।
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল প্রতিটি মানুষের প্রত্যাহিক জীবনযাপনের সঙ্গে দুর্নীতি অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতিহীন জীবনযাপন আমাদের সব মানুষের জন্যই যেন প্রায় অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়। আমাদের নৈতিকতার ওপর এটা (দুর্নীতি) একটা বিরাট হামলা। একটি দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে সেবাগুলো পাওয়ার কথা তা পেতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। যে সেবাদানের দায়িত্বে রয়েছে তাকে দিয়ে কাজ করাতে গেলে বিশেষ কিছু করতে হয়। যদি না করা হয় তাহলে সেবা পাওয়া যায় না। এ বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে হলে প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’
দুর্নীতির এ করাল গ্রাস থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রতিবেদনে টিআইবি ১১ দফা সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যমান আইনের আওতায় আনা, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুদৃঢ় নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা এবং এর ভিত্তিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেবা প্রদানে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং সেবাহগ্রহীতা ও সেবাপ্রদানকারীর মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধিসহ গণশুনানির আয়োজন করা; বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও তিরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা করা; জনবল-অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের ঘাটতি দূরীকরণে সেবা খাতগুলোতে আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত সাতটি খানা জরিপ করেছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে জরিপ হয়েছিল। ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সেবার ওপর ভিত্তি করে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহের সময় ছিল গত ১ নভেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এবারের জরিপে অংশগ্রহণকারী খানার সংখ্যা ১৫ হাজার ২০৬টি।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাপত্র পাঠ করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদুর আলম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম। প্রতিবেদনের ওপর আরও বক্তব্য রাখেন, টিআইবির উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের ও পরিচালক (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.