চকবাজারে আগুন: স্বজনদের আহাজারি

পুরান ঢাকার চকবাজারের দেবীদ্বার ঘাট লেনে বরিশাল হোটেল। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা চলে এ হোটেলটি৷ দুই শিফটে হোটেলে ১২-১৫ জন কাজ করতেন।

রাতভর কাজ করে এক শিফটের ছয় কর্মী সোমবার (১৫ আগস্ট) ভোর ৬টার দিকে ঘুমাতে যান হোটেলের ওপরে মাচানে। সবাই ঘুমিয়েছিলেন।

হঠাৎ দুপুরে আগুন লাগে। তখনও হোটেলের মাচানে ছয় কর্মী ঘুমে।

ঘুমানো অবস্থায় আগুনে ঝলসে গেছে সবার শরীর।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলে বিকেলে বরিশাল হোটেলের ভেতরের মাচান থেকে ওই ছয় জনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের কর্মীরা।

আগুনে নিহতরা হলেন- ওহাব আলী ওসমান (২৫), বেল্লাল সরদার (৩৫), স্বপন সরকার (১৮), মোতালেব (১৬), শরীফ (১৬) ও রুবেল (২৮)। তাদের মরদেহ মিটফোর্ড মর্গে রাখা হয়েছে।

যখন আগুন লাগে তখন হোটেলের মেসিয়ার স্বপন সরকার ঘুম থেকে জেগে যান। তিনি দ্রুত তার চাচাতো ভাইকে ফোন করে জানান আগুনের কথা। এরপর তার ফোন বন্ধ হয়ে যায়।

নিহত স্বপনের চাচাতো ভাই বাদশাহ সরকার কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন- ‘আগুনে যেমনে পুড়ছে ভাইয়ের মুখটা, চেনার কোনো উপায় নাই’। আহারে আমার ভাইটা মারা গেলো। ওর লাশটা কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফেরা লাগবে, কষ্টে বুকটা ফাইটা যায়।

কথা হলে বাদশাহ বলেন, স্বপন সরকারের বাড়ি হবিগঞ্জের বামৈন গ্রামে। হোটেল থেকে ছুটি পাইলেই স্বপন আমার সঙ্গে দেখা করতে যাইতো। দুপুরে স্বপন আমাকে ফোন করে বলছিল- ভাই আগুন লাগছে। এরপর থেকে স্বপনকে আর ফোনে পাইনা। মর্গে আইসা জানলাম, ভাই মারা গেছে। এখন লাশ মর্গে আছে। মঙ্গলবার স্বপনের লাশ দেওয়া হবে।

মিডফোর্ড মর্গে লাশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নিহত ওসমানের পরিবার। আগে কুয়েতে ছিলেন ওসমান। করোনার কারণে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। সেখানে তার চাকরি চলে যায়।

কথা হলে নিহত ওসমানের বোনজামাই আরিফ সরদার বলেন, ওসমানের বাড়ি শরীয়তপুরের গোঁসাইরহাট উপজেলায়। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে ওসমান ছিলেন মেঝো। বরিশাল হোটেলে মেসিয়ার হিসেবে কাজ করতেন ওসমান। দৈনিক মজুরি পেতেন ৬০০ টাকা। করোনার সময় চাকরি হারিয়ে কুয়েত থেকে ফিরে আসেন তিনি। কুয়েত থেকে ফিরে আসাই কাল হল ওসমানের।

ওসমানের ছোট ভাই ইকবাল বলেন, ভাইজান চার পাঁচদিন আগে আমার পড়ালেখার জন্য টাকা পাঠিয়েছিলেন। সবসময় বলতেন, টাকার জন্য চিন্তা করিস না। তুই মন দিয়ে পড়িস৷ ভালো রেজাল্ট করা লাগবে৷ আর এখন আমি বাড়ি যাবো ভাইয়ের লাশ নিয়া।

অনটনের সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে মরিয়া ছিলেন বরিশালের মুলাদী উপজেলার বেল্লাল সরদার। স্ত্রী ও ছেলে মেয়েকে বাড়ি রেখে তিনি কাজের সন্ধানে এসেছিলেন ঢাকায়৷ দশ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে কাজ করেছেন। বরিশাল হোটেলে এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে কাজ করছিলেন তিনি।

মিটফোর্ডের মর্গের সামনে ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করছিলেন রুমা বেগম। তিনি বলেন, আমার ভাই এতোই ব্যস্ত ছিল যে আমাদের সঙ্গে কথা বলারও সময় পেত না। বাড়িতেও যেত কম। তার ছেলে তানভীর পড়ে মাদরাসায়, মেয়ে সুমাইয়া পড়ে ক্লাস সেভেনে। আমরা পাঁচ ভাই, পাঁচ বোন। আমি সবার বড়। বেল্লাল ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়৷

আজ আমার আদরের ভাইটা মারা গেলো। আমি কেমনে ভাইয়ের লাশটা নিয়া আম্মার সামনে যাবো? কেমনে মানবো আমার ভাইটা নাই৷ তার বউ ছেলে মেয়েরে কি জবাব দেব?

এদিকে মাত্র ২০ দিন আগে হোটেলে এসেছিলেন শরীফ। সপ্তাহ তিনেক আগে বরিশাল হোটেলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কুমিল্লার চান্দিনায় তার বাড়ি৷ দৈনিক ২০০ টাকা বেতনে গ্লাস বয়ের কাজ করতেন তিনি। ১৬ বছরের যুবক শরীফ এসেছিলেন পরিবারের অভাব- অনটন ঘুচাতে। কিন্তু আগুন তার স্বপ্ন কেড়ে নিলো।

শরীফের নানা আবুল কাশেম মর্গে শরীফের মরদেহ শনাক্ত করেন৷ মর্গে আসেন তার নানী সালমা বেগম। তিনি আহাজারিতে লুটিয়ে পড়েন। শরীফের খালা নাসরীন আক্তারের বিলাপে ভারী হয়ে উঠে মর্গের পরিবেশ।

বরিশাল হোটেলের ৬ কর্মীর পরিবার অভিযোগ করেছেন, হোটেল কর্তৃপক্ষ ও ভবন মালিকের অবহেলার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। দোষীদের শাস্তির আওতায় আনারও দাবিও জানান তারা।

প্রসঙ্গত, দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর চকবাজারের কামালবাগের দেবীদাস ঘাটের প্লাস্টিক কারখানা ও গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.