ডিবি হারুনের পাসপোর্ট জালিয়াতির তথ্য ফাঁস

ঢাকা মহানগর পুলিশের আলোচিত অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিআইজি) ও সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ তথ্য গোপন করে পাসপোর্ট নিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের পাসপোর্ট অফিসিয়াল হওয়ার কথা, কিন্তু ডিবি হারুনের পাসপোর্ট অর্ডিনারি বা সাধারণ। জালিয়াতির মাধ্যমে হারুনের নেওয়া পাসপোর্টের নথি সামনে এসেছে। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন।

এর আগে পুলিশের সাবেক আইজিপি আলোচিত বেনজীর আহমেদও জালিয়াতির মাধ্যমে পাসপোর্ট নেন। সরকারি কর্মকর্তা হলেও তার পাসপোর্টে পেশার স্থা&নে ‘প্রাইভেট জব’ লেখা ছিল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বেনজীর আহমেদকে দেওয়া পাসপোর্ট চক্রটিই হারুন অর রশিদকে পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেছে। এই কাজে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক সাইদুল ইসলাম ও সিলেট বিভাগীয় পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় এই কর্মকর্তারা ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শেষ অফিসিয়াল পাসপোর্ট নবায়ন করেন হারুনুর রশিদ। ওই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত।

এরপর তিনি ২০১৭ সালের ১৫ জুন সরকারি পাসপোর্ট জমা দিয়ে গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসে নতুন সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন করেন। তার আবেদনের মাত্র ১১ দিনের মধ্যেই তিনি সাধারণ পাসপোর্ট তুলে নেন। এই পাসপোর্টের মেয়াদও ছিল ৫ বছর। অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৮ জুন থেকে ২০২২ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত।

২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি তিনি আগারগাঁওয়ের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে পুনরায় পাসপোর্টের আবেদন করেন। এই পাসপোর্টও ছিল সাধারণ। ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি পাসপোর্টটি গ্রহণ করেন। এই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

এর মধ্যে তিনি ২০২১ সালের ৪ আগস্ট আগারগাঁও বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন এবং তা গ্রহণ করেন ১৭ আগস্ট। এই পাসপোর্টের মেয়াদ ১০ বছর। অর্থাৎ ২০২১ সালের ৪ আগস্ট থেকে ২০৩১ সালের ৩ আগস্ট পর্যন্ত।

পাসপোর্ট অফিসের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একজন সরকারি কর্মকর্তা কখনোই অর্ডিনারি পাসপোর্ট গ্রহণ করতে পারেন না। আর হারুনুর রশিদ পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার পাসপোর্ট অবশ্যই অফিসিয়াল হতে হবে। হারুন প্রভাব খাটিয়ে কিংবা তৎকালীন পরিচালকের সঙ্গে বিশেষ সখ্য গড়ে এই পাসপোর্ট পেয়েছেন।

জানতে চাইলে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু বলেন, বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। খোঁজ নেওয়া হচ্ছে কারা কারা এই ঘটনায় সহায়তা করেছে। জড়িত সবাই অবশ্যই শাস্তির আওতায় আসবে।

সূত্র জানায়, পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়াও বেনজীর আহমেদকে জালিয়াতির মাধ্যমে পাসপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা দুদকের মামলারও আসামি তিনি।

তৌফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধেও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক সাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে দুদক তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, আমার দায়িত্ব পালনের সময় তাকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে কিনা জানা নেই। আপনার কাছে তথ্য থাকলে আপনি লিখতে পারেন।

অপর দুই কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম ও আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে, এমনকি মেসেজ পাঠিয়েও এ সম্পর্কে তাদের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পাশাপাশি হারুন অর রশিদের পাসপোর্টে দেওয়া তার মোবাইল নম্বরে যোগোযোগ করা হলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে থেকেও নিজেকে বেসরকারি চাকরিজীবী দেখিয়ে পাসপোর্ট তৈরির ঘটনায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে গত ১৪ অক্টোবর মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলায় আরও চার জনকে আসামি করা হয়। মামলার অপর আসামিরা হলেন ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সাবেক পরিচালক মো. ফজলুল হক, সাবেক পরিচালক মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম, পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন এবং ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের টেকনিক্যাল ম্যানেজার সাহেনা হক।

দুদক জানায়, বেনজীর আহমেদ সরকারি চাকরিজীবী হওয়া সত্ত্বেও পাসপোর্টের আবেদনপত্রে পেশার স্থানে ‘প্রাইভেট সার্ভিস’ উল্লেখ করে জাল জালিয়াতি-প্রতারণার আশ্রয় নেন। পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি, অতিরিক্ত আইজিপির পদমর্যাদায় র‌্যাবের মহাপরিচালক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার পদে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি এই জালিয়াতি করেন। তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ‘প্রাইভেট সার্ভিস’ উল্লেখ করে বিভিন্ন সময়ে বিভাগীয় অনাপত্তিপত্র (এনওসি) ছাড়াই মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও ই-পাসপোর্টের (ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট) জন্য আবেদন করেন।

দুদকের ভাষ্য, বাকি চার আসামি বেনজীর আহমেদের দাফতরিক পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত ছিলেন। এরপরও বিভাগীয় অনাপত্তি সনদ (এনওসি) যাচাই না করে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে পরস্পর যোগসাজশে বেনজীর আহমেদের নামে সাধারণ পাসপোর্ট ইস্যু ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। এ ধরনের অনুমোদন দণ্ডবিধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন এবং দ্য বাংলাদেশ পাসপোর্ট অর্ডার ১৯৭৩-এর ১১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.