বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ প্রবাসী কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বিমানবন্দরে অবহেলা ও অমর্যাদার শিকার হয়ে আসছিলেন, কারণ কর্মকর্তারা সাধারণত তাদের সম্মান বা সাহায্য প্রদানে উদাসীন থাকতেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে আরও ভালো আচরণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে ২৩ অক্টোবর দেশে ফেরার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা প্রবাসী কর্মী জুবায়েরকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করায়, তিনি অবাক হন।
জুবায়ের বলেন, “এই প্রথম আমাকে বিমানবন্দরে এভাবে সম্মান জানানো হলো,”
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ প্রবাসী কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বিমানবন্দরে অবহেলা ও অমর্যাদার শিকার হয়ে আসছিলেন, কারণ কর্মকর্তারা সাধারণত তাদের সম্মান বা সাহায্য প্রদানে উদাসীন থাকতেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে আরও ভালো আচরণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
অবশেষে শেখ হাসিনার পতনের পর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে, যেখানে প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা শুধু অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল মাধ্যমে অর্থ পাঠিয়ে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করে। পরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর, প্রবাসী কর্মীদের প্রতি সম্মান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন, ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীরা বিমানবন্দরে “ভিআইপি সেবা” পাবেন। “সেবার মান ইতোমধ্যেই উন্নত হয়েছে” বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ভিআইপি সেবার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, কর্মীরা লাগেজ, চেক-ইন ও ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় সাহায্য পাবেন; আর বিমানবন্দরে প্রবাসীদের ওপর কোনো ধরনের হয়রানি বা অপমান সহ্য করা হবে না।
১১ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশের প্রবাসী কর্মীদের জন্য একটি বিশেষ লাউঞ্জ উদ্বোধন করেন। এই লাউঞ্জে বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীরা বিশ্রাম নেওয়ার পাশাপাশি ছাড়মূল্যে খাবার পাবেন।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের প্রবাসী কর্মীরা জাতি গঠনে ভূমিকা রাখেন। জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানে তাদের বড় ভূমিকা ছিল। আমরা তাদের প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।”
বিমানবন্দরটি পরিদর্শন করে এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসা প্রায় দুই ডজন প্রবাসী কর্মীর সঙ্গে কথা বলে বিমানবন্দরে কি ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা জানার চেষ্টা করেছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
কুয়েত থেকে ফিরে আসা নারায়ণগঞ্জের মোহাম্মদ শুভ বলেন, “এবারের অভিজ্ঞতা আগের চেয়ে ভালো ছিল। আমি আগের চেয়ে দ্রুত আমার লাগেজ পেলাম। আগে তারা আমাদের লাগেজ সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করত না। আমার বন্ধুদের লাগেজের ক্ষতিও হয়েছে। কিন্তু এইবার আমি দেখলাম, বিমানবন্দর কর্মকর্তারা বেশি সতর্ক ছিলেন।”
তবে, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সেবাকে কিছুটা ধীর বলেছেন শুভ। বাংলাদেশ বিমানের বিরুদ্ধে তার অনেক অভিযোগ ছিল। তিনি বলেন, “তারা সবসময় দেরি করে। এইবারও আমাদের দুই ঘণ্টার বেশি দেরি হয়েছে।”
একই ফ্লাইটে শুভর সঙ্গে ফিরে আসা নড়াইলের প্রবাসী মারগুবুর রহমান বলেন, বিমানের ফ্লাইটটি রাত ৩টায় উড্ডয়ন করে, যদিও তা রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে উড্ডয়ন করার কথা ছিল। তিনি বলেন, “অন্য এয়ারলাইন্সগুলো বিমানের মতো দেরি করে না।”
তবে, মারগুবুর বিমানবন্দরে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে খুশি ছিলেন।
তিনি বলেন, “পুলিশ আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত, অতিরিক্ত প্রশ্ন করত। কিন্তু এইবার তারা ভালো ব্যবহার করেছে, আর আমার লাগেজও আগেই এসে পৌঁছেছিল। বিমানবন্দর কর্মকর্তারা আমাদের গাইড করেছেন এবং আমাদের খোঁজখবর নিয়েছেন।”
পাবনার সৌদি প্রবাসী শিপন হোসেন বলেন, তিনি সার্বিক সেবায় সন্তুষ্ট। “আগে আমাদের প্রতি এমন আচরণ করা হত যেন আমরা নীচু স্তরের মানুষ। এখন মনে হচ্ছে অনেক উন্নতি হয়েছে,” তিনি বলেন।
কিশোরগঞ্জের শাহিন মিয়া, যিনি আট বছর সৌদিতে প্রবাসী কর্মী ছিলেন এবং এখন পর্যন্ত চারবার দেশে ফিরেছেন, তিনি বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা আগের চেয়ে খারাপ ছিল। আমার লাগেজ আসতে এক ঘণ্টা লেগেছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিমানবন্দর আমাদের ট্রলি বাইরে নিতে দেয় না, যেটি আমাদের কাজে লাগে। আমাদের অনেক লাগেজ থাকে। একমাত্র উপায় হলো পোর্টার ডাকা। অন্যান্য দেশগুলো আমাদের আরও সম্মান এবং সুযোগ দেয়।”
লক্ষ্মীপুরের আরেক প্রবাসী শিহাব, যিনি অক্টোবর মাসে সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন, বলেন, “আমাকেও লাগেজ পেতে এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “সৌদিতে আমাদের লাগেজ সাবধানে হ্যান্ডেল করা হয়। কিন্তু এখানে আমাদের লাগেজ সতর্কভাবে হ্যান্ডেল করা হয় না। আমাদের লাগেজে মূল্যবান জিনিস থাকে। যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বিমানবন্দর কি ক্ষতিপূরণ দেবে?”
“অনেকে বলছেন যে কিছু কিছু উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই পরিবর্তন হয়নি,” তিনি যোগ করেন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের শরিফুল হাসান বলেন, “বিমানবন্দর সেবার মান এমন হওয়া উচিত যাতে প্রত্যেক যাত্রী সমানভাবে সেবা পায়, হোক সে সরকারি কর্মকর্তা, প্রবাসী বা অন্য কেউ। যদি বিশেষ কিছু গ্রুপের জন্য সেবা পরিকল্পনা করা হয়, যেমন প্রবাসী কর্মীদের জন্য, তবে তা সব যাত্রীর জন্য পর্যাপ্ত হতে পারে না।”
তিনি বলেন, বহির্গামী যাত্রীদের চেয়ে অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের দিকে বেশি নজর দিতে হবে, কারণ তারা সাধারণত ফেরার সময় বেশি সহায়তা প্রয়োজন; বিশেষত লাগেজ এবং ব্যাগেজের বিষয়টি নিয়ে।”
শরিফুল হাসান বলেন, “জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পরিবর্তে, সিদ্ধান্তগুলো টেকসই এবং সমাধানমুখী করা উচিত। কখনও কখনও, সেবাগুলো জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তাড়াহুড়া করে করা হয়, বিশেষ করে সরকারে যারা দ্রুত উন্নতির প্রমাণ দিতে চায়।”
তিনি আরও বলেন, “যদি আমরা সত্যিই প্রবাসী কর্মীদের সহায়তা করতে চাই, তাহলে আমাদের সফলতা মাপা উচিত তাদের বিদেশে যাত্রার খরচ কতটা কমানো গেছে এবং শোষণ কতটা কমানো গেছে, তার ওপর ভিত্তি করে। দুঃখজনকভাবে আমি বিশ্বাস করি, আমরা এখনো এই লক্ষ্য অর্জনে অনেক দূরে আছি।”
–দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড