কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতিতে সবচেয়ে বড় বাধা অদক্ষতা

কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতিতে সবচেয়ে বড় বাধা অদক্ষতা।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় হলেও অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। কারণ এর অর্থনৈতিক কাঠামোয় সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল দক্ষ শ্রমিকের অভাব। মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর ঘাটতিও ব্যাপক। এক কথায় দেশের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও সেবা খাতসংশ্লিষ্ট সার্বিক ব্যবস্থাপনার কোনোটিতেই প্রত্যাশিত দক্ষ কর্মী নেই।
আশঙ্কার কারণ হল কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৮৬ শতাংশ অদক্ষ। আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। অর্থাৎ অদক্ষতার ভারে দিন দিন দুর্বল হচ্ছে অগ্রসরমান অর্থনীতি।
২০১৫ সালে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৮ সালে এসেও সেটি সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হিসেবে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউটিও, আইএমএফ, এডিবি ও আইডিবিসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা তাদের পর্যবেক্ষণে তা সুনির্দিষ্ট করেছে।
সেখানে অগ্রসরমান অর্থনীতির প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণের মধ্যে প্রথমে রেখেছেন দক্ষতার ঘাটতির বিষয়টি।
কর্মক্ষম শ্রমশক্তির এ বেহাল দশা নিয়েই বাংলাদেশ এখন মোটা দাগে তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক. ২০২৪ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি আদায়। দুই. ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং তিন. ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পৌঁছানো।
এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সবার আগে দরকার মানবসম্পদের উন্নয়ন। মানসম্মত শিক্ষা, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষাই পারে এর নিশ্চয়তা দিতে। এটাই দক্ষতা উন্নয়নের কার্যকর উপায়।
দক্ষতা থাকলে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্থায়ী আয়-উপার্জন এবং শ্রমের বিনিময়ে ভালো অর্থপ্রাপ্তিরও নিশ্চয়তা মেলে। এর প্রভাবে পরিবারের সমৃদ্ধি ঘটে। এর সার্বিক প্রভাবে অর্থনীতি কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধির দিকে চালিত হয়।
অর্থনীতিতে দক্ষ লোকের সংখ্যা যত বেশি হবে সার্বিক প্রবৃদ্ধিও তত দ্রুত হবে। পাশাপাশি সেটি টেকসইও হবে।
এ প্রসঙ্গে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে না পারলে বিশেষ করে কর্মক্ষম যুবশক্তিকে অদক্ষ রেখে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। তাই সরকার দক্ষতা উন্নয়নে জোর দিচ্ছে। যুগান্তরকে তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক মোট ৭৫টি ট্রেডে দেশব্যাপী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ৯ বছরে ২২ লাখ ৩৭ হাজার ৮৬ জনকে এসব ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ যুবক ও যুব মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু দক্ষতা উন্নয়ন নয়, পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবেও তাদের গড়ে তোলার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে যুগোপযোগী ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং, হাউজকিপিং, ট্যুরিস্ট গাইড, ফ্রন্ট ডেস্ক, ম্যানেজমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, ই-লার্নিং, কোয়েল পালন কোর্সে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতসহ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, নির্মাণ, হালকা প্রকৌশল, তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ ২৬টি খাতে দক্ষ লোকের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। অথচ সংকট উত্তরণের কার্যক্রম চলছে খুব ঢিমেতালে। সরকার, আমলা, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা এবং রাজনীতিকদের কাছে এটি গুরুত্বহীন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষতা উন্নয়নের কার্যক্রমে গতি না পেলে ডাবল ডিজিটে প্রবৃদ্ধি অর্জন তো দূরের কথা, কাঙ্ক্ষিত তিনটি লক্ষ্যের কোনোটির দ্বারপ্রান্তেই পৌঁছানো যাবে না।
এ প্রসঙ্গে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক আবদুস সালাম বলেন, কর্মক্ষম ও দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে তরুণদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। সবার আগে তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।
ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন ডিসিসিআই সূত্রমতে, ২০১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৬ শতাংশ হারে হয়েছে। এ সময় মাত্র ২৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ তখন দেশে চাকরিরত মানুষের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি সাত লাখে। এ হিসাবে কর্মসংস্থানের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১.১২ শতাংশ, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির এক-ষষ্ঠাংশেরও কম।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) ‘লেবার মার্কেট অ্যান্ড স্কিল গ্যাপ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দাবি করা হয়, দক্ষ জনশক্তির অভাব বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে বড় বাধা। কেননা উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং দক্ষ শ্রমশক্তির মধ্যে পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দরকার দক্ষ শ্রমশক্তি। আবার শ্রমশক্তির চাহিদা বাড়ার জন্য দরকার উচ্চ প্রবৃদ্ধি। তবে চাহিদা হবে দক্ষ শ্রমিকেরই।
এতে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, শিগগিরই দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে না পারলে প্রবৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে আটকে থাকবে। একপর্যায়ে সেটিও আর ধরে রাখা যাবে না। এমনটি হলে উন্নয়নশীলের ধাপ পেরিয়ে উন্নত দেশে পৌঁছানোর স্বপ্ন একটা সময় দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।
অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, কর্মক্ষম (কাজ করার উপযোগী) জনসংখ্যা দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনার বড় জায়গা। দক্ষ ও সুপ্রশিক্ষিত শ্রমশক্তিই পারে দেশকে বদলে দিতে। কিন্তু গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা এ শ্রমশক্তি তৈরি করতে পারছে না। আবার কারিগরি শিক্ষার যে ব্যবস্থা রয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। পরিবর্তিত কর্মক্ষেত্র এবং প্রযুক্তির সঙ্গেও সেটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাদের যে গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা পাওয়া দরকার, তাতেও ঘাটতি আছে। যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তা যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করে না এবং বাজারের চাহিদাও মেটায় না। ফলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটিও দীর্ঘসূত্রতায় আটকে আছে।
সর্বশেষ শ্রমশক্তির জরিপ (২০১৬-১৭) : বিভিন্ন বয়সী কর্মক্ষম মোট জনগোষ্ঠী দেখানো হয় ১০ কোটি ৯০ লাখ। যার সংখ্যাগরিষ্ঠই অর্থনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারছে না। জরিপের তথ্যমতে, মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৪ লাখ মানুষের মধ্যে কর্মক্ষম (৬৫-তদূর্ধ্ব) বয়সী লোক আছে ৭৯ লাখ। আবার ১৫-৬৪ বয়সীর এ সংখ্যাটি ১০ কোটি ১১ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় শতকরা ৬২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
অপরদিকে ১৫-২৯ বয়সীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। যা মোট জনসংখ্যার ৭৯ ভাগ।
বিভিন্ন পর্যালোচনায় মূলত এই তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব মোচন এবং দক্ষতা উন্নয়নের ভাবনাটিই এই সময়ের বড় দাবি হয়ে উঠছে।
কিন্তু তার অগ্রগতি সেভাবে হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দক্ষতাপূর্ণ শ্রমজরিপ তথ্য পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তথ্যানুযায়ী, কারিগরি শিক্ষার হার উন্নত দেশে ৬০ শতাংশের বেশি। ভারতে এটি ২৭ শতাংশ, নেপালে ২৩ শতাংশ, শ্রীলংকায় ৪০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েট লেভেলে কারিগরি শিক্ষায় পাসের হার মাত্র ১৪ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর থেকেই বোঝা যায়, এ দেশগুলোর উন্নতির সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার সম্পর্ক কী? আমাদেরও বুঝতে হবে এর গলদটা কোথায়?
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, কারিগরি শিক্ষার অপর্যাপ্ততার প্রভাব পড়ছে সার্বিক কর্মসংস্থানে। উৎপাদন তথা উন্নয়ন-অগ্রগতিতে বাধা আসছে। সরকারি খাতে চাকরির সুযোগ কম। বেসরকারি খাতে রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
এর অভাবে অনেক মেধাবী ও উচ্চতর ডিগ্রিধারীরাও থাকছে বেকার অথবা চাহিদা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছে না। তিনি বলেন, জনগোষ্ঠীর ৭৯ শতাংশ হচ্ছে যুবশক্তি। তিনি আরও বলেন, উচ্চশিক্ষা ব্যক্তিগতভাবে লাভজনক হলেও এটা উৎপাদনশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করে না। এ পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধির পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হলে কর্মমুখী দক্ষতা, প্রশিক্ষণের মান ও উৎপাদনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বিকল্প নেই।
আইএলও’র ‘ডিসেন্ট ওয়ার্ক ডিকেড : এশিয়া, প্যাসিফিক অ্যান্ড দ্য আরব স্টেট’ শীর্ষক ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ চ্যাপ্টার সম্পর্কে আশঙ্কাজনক তথ্য দেয়া হয়েছে। এ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এ দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪০ শতাংশ তরুণ শিক্ষায় নেই, চাকরি করছেন না, আবার চাকরিতে যোগ দেয়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণও গ্রহণ করছেন না। যদিও তারা শ্রমবাজারেরই অংশ কিন্তু পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়।
মধ্যপ্রাচ্যের ২১টি দেশের মধ্যে খারাপের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সাধারণ শিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া তরুণদের অনেকে শ্রমবাজারে খাপ খাওয়াতে পারেন না।
নিজের সামাজিক জীবনমানের পাশাপাশি দেশের উন্নতির জন্য দরকার কারিগরি শিক্ষার প্রসার। এজন্য বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে এ তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। এর জন্য শিক্ষা পরিকল্পনাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশলের অংশ হিসেবে দেখতে হবে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.