‘ভ্রমণ’ আমার জীবনের একটি বড় অংশ। সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে যাই। তবে করোনার কারণে এ বছর সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আমার সর্বশেষ বিদেশ ভ্রমণ (যুক্তরাষ্ট্র) ৩১ ডিসেম্বর। আর সর্বশেষ দেশের ভেতরে (সেন্টমার্টিন-কক্সবাজার) ঘুরতে যাওয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি।
দীর্ঘ ১৭৫ দিন পর মাত্র ২৩ ঘণ্টার জন্য কক্সবাজারে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। তবে বিমানবন্দরে এসে দেখলাম অনেক কিছুই বদলে গেছে। আমি নিজে বদলে যাওয়া পছন্দ করি। তাই এসব নতুনত্ব আমার কাছে খারাপ লাগে না। তবে ছেলে ৯৯% ভাল (বদলে গেছে) কিন্তু মাঝে মাঝে একটু নাইট ক্লাবে (যে বদলে যাওয়া ক্ষতির কারণ) যায় আর কি!
আরেকটু খোলাসা করি বলি। ৬ আগস্ট কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক টার্মিনালে যাই। কক্সবাজারে যাবো নভোএয়ারে আর ফিরে আসবো ইউএস বাংলায়। গেট দিয়ে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলো কোন এয়ারে? আমি বললাম, নভোএয়ার। সিকিউরিটি পাশের গেট দেখিয়ে বললো, এই গেট না; ওই গেট দিয়ে নভোর যাত্রী প্রবেশ করবে।
আমি এয়ারপোর্টে ঢুকতে গিয়েই তাদের এই সচেতনতা দেখে মুগ্ধ হওয়া শুরু করলাম। এই গেট নির্ধারণের ফলে হুড়োহুড়ি কম হবে। নিরাপত্তার সাথে প্রবেশ করা যাবে। বিষয়টিকে আমি সাধুবাদ জানালাম এবং পাশের গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম।
ভেতরে ঢুকতেই তাপমাত্রা মাপলো। ব্যাগ স্ক্যান করালো। সিকিউরিটি চেক করলো। এরপর হাতে একটি ফরম ধরিয়ে দিল এবং সেখানে দেখি তাপমাত্রা আগে থেকেই লেখা ছিল। সবার তাপমাত্রা একই লেখা (কারণ বারবার লেখার ঝামেলা এড়াতে একেবারেই লিখে রাখা)। তাপমাত্রা মাপার বিষয়টি ভাল লাগলেও ফরমে আগে থেকে তাপমাত্রা লিখে রাখার বিষয়টি আমার ভাল লাগেনি।
তবে যেটা ভাল লাগলো সেটা হচ্ছে, এয়ারপোর্টের ভেতরে এক সিট খালি রেখে বসার জন্য চেয়ারগুলোতে লেখা- Not To Be Seated, Social Distancing. Keep Distance. দেখে খুবই ভাল লাগলো। খুব স্বস্তি বোধ করলাম। এরপর গেটে দেয়া ফরমটি নিয়ে বসলাম। কিন্তু ফরম দেখে আবার অস্বস্তি শুরু হলো। এই ফরম লেখার ফায়দা কী? কারণ জমা দেয়ার সময় দেখলাম ফরমে সঠিক না ভুল লেখা তা ক্রসচেক করা হচ্ছে না এবং তা করারও সুযোগ নেই।
ফরমে লেখা ছিল- ‘বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ যাত্রীর স্বাস্থ্য তথ্য ফরম। চেক-ইন এর পূর্বে সকল যাত্রীর জন্য ফরমটি পূরণ অবশ্য কর্তব্য। ফরমটি একজনের জন্য প্রযোজ্য। ভুল তথ্য প্রদানের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ ফরমে নাম, বয়স, লিঙ্গ, জন্ম তারিখ, বর্তমান ঠিকানা, এয়ারলাইন্স, জাতীয়তা, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার, মোবাইল, ফ্লাইট নাম্বার, শরীরের তাপমাত্রা, ই-মেইল এড্রেস চাওয়া হয়েছে।
এরপর তিনটি প্রশ্ন রয়েছে। ১. আপনার কি জ্বর বা কাশি আছে? ২. আপনার কি জ্বর বা শ্বাসকষ্টজনিত কোনো সমস্যা আছে? এবং ৩. আপনি কি বিগত ১৪ দিনের মধ্যে কোভিড-১৯ এর কারণে বোর্ডিং থেকে ফেরত এসেছেন? প্রশ্নগুলো ভাল। কিন্তু কে দেখবে এসব? কে চেক করবে? নাকি শুধুই ফর্মালিটি? শেষ পর্যন্ত দেখলাম এটা শুধুই ফর্মালিটি। ফ্লাইটে ওঠার আগে এই কাগজটি নিয়ে রাখা হচ্ছে। কেউ কিছু দেখছেও না। তাহলে এটা শুধু শুধু লেখার কী দরকার ছিল? ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে হলে ঠিক আছে। তাও সেটা অবশ্যই ক্রসচেক করতে হবে। অন্তত মোবাইল নাম্বারটা ঠিক আছে কিনা সেটা দেখলেও বায়োমেট্রিকের কারণে কিছু তথ্য পাওয়া যেত। কিন্তু এটা হয়রানি করার জন্য ডোমেস্টিকে দেয়া হয়েছে।
এবার কাউন্টারে গেলাম বোর্ডিং করার জন্য। কাউন্টারের লোকটির সামনে গ্লাস দিয়ে প্রটেকশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আদতে সেটার কোনো কাজ নেই। গ্লাসের বাইরের অংশ থেকেই বোর্ডিং পাস দেয়া হলো। সেখানে থেকে এবার আরেক দফা সিকিউরিটি ফেস করতে হবে। নায়িকা শিমলার বয়ফ্রেন্ডের কারণে এই বিভাগে সিকিউরিটি খুবই কঠিন। চেক করার সময় পারলে প্যান্টও খুলে রাখতে চায়! হাত ঘড়ি, আংটি, বেল্ট, জুতা, ব্যাগ সব স্ক্যান করে পারলাম।
ভেতরে এসেও বসার সিটে একটা করা সিট খালি রেখে বসতে হচ্ছে। আরামেই বসলাম। যথা সময়ে ফ্লাইটের টাইম হলো। আমরা বাসে চড়ে প্লেনের কাছে গেলাম। সবাই প্লেনে ঢুকতে পারলেও আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। কারণ আমি ভুলে তাদের কাউন্টার থেকে হ্যান্ড গ্লাভস নেইনি! তারাও আমাকে দেয়নি এবং আমার জানাও নেই এটা বাধ্যতামূলক। আমাকে এক পাসে দাঁড়িয়ে রেখে বললো আমরা গ্লাভস আনার জন্য ওয়্যারলেসে বলে দিয়েছি। নিয়ে আসলেই প্রবেশ করতে পারবেন।

আমাদের নিরাপত্তার জন্য তাদের কত্ত আয়োজন। আমি যেন কোনোভাবেই কারো মাধ্যমে ভাইরাসে আক্রান্ত না হই বা আমার মাধ্যমে যেন ভাইরাস না ছড়িয়ে পড়ে। তাই এটাও দেখে ভাল লাগলো। কিছুক্ষণ পর গ্লাভস এলো। ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ঢুকে আমার মাথায় হাত! বাইরে এত আয়োজন করে এখানে কোনো সিট খালি রাখা হয়নি!! এটিআর এয়ারক্রাফটে সব গায়ে গায়ে বসে আছে। তাহলে বাইরে এত রঙ ঢঙ করার কী দরকার ছিল?
ফ্লাইট ছাড়লো। এই প্রথম কোনো ফ্লাইটে কোনো খাবার পেলাম না। পানিও দিল না। আগে জানলে চিড়ামুড়ি সাথে করে নিয়ে আসতাম। ৫০ মিনিটের মধ্যে আমরা কক্সবাজারে পৌঁছে গেলাম। বৃষ্টিভেজা দুপুরে সামান্য রাস্তাটুকু পার হওয়ার জন্য বিমানের কর্মীরা ছাতা ধরিয়ে দিল। কিন্তু সামনে গিয়ে দেখি আবার দীর্ঘ লাইন। লাইনে ঢোকার আগে আবার তাপমাত্রা মাপা হলো। এরপর লাইনের কাছে গিয়ে দেখলাম ঢাকায় যে ফরম পূরণ করে এসেছি এখানেও সে রকম একটা ফরম পূরণ করতে হচ্ছে। এছাড়া একটা লেজার খাতায় নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার লিখে তার পর বের হতে হচ্ছে।
আচ্ছা, এভাবে নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার খাতায় লিখে রাখলে কী করোনা ধরতে পারবে না? তা যদি না হয় তাহলে পদে পদে এত ভোগান্তি কেন? আর সব জাগায় এত নিরাপত্তা দেখালেও ফ্লাইটের ভেতরে পাশাপাশি মানুষ বসাচ্ছেন কেন? কে দেবে এসব উত্তর? বাই দ্য ওয়ে, ঢাকায় ফেরার পথে এই ভোগান্তি পাড়ি দিতে হয়েছে। আরেকটা কথা, কক্সবাজার থেকে ফ্লাইট ছাড়ার সময় একটি বিষয় দেখে অবাক হয়েছিলাম। যেখানে ফ্লাইট চলছে সেখানে কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। সেই কুকুর কি আমাদের মতই নিরাপত্তা গণ্ডি পেরিয়ে এখানে প্রবেশ করেছে? তা না করলে এখানে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে দায় নেবে কে?
লেখক : মিজান সোহেল