অর্থ-সম্পদ পাচার, বিদেশে থাকাদের ফেরাতে ইন্টারপোলের দ্বারস্থ দুদক

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা লোপাট করে ইতিমধ্যে অনেকেই বিদেশে চলে গেছেন। হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ কিংবা পাচারের অভিযোগে মামলাও রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। লাপাত্তা
হওয়া এই ব্যক্তিদের দেশে এনে আইনের মুখোমুখি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

অর্থ আত্মসাৎ ও টাকা পাচারকারী এসব ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সংস্থাটির বাংলাদেশ শাখায় মার্চ মাসেই চিঠি পাঠায় দুদক। দুদক সূত্র জানায়, প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীসহ সাতজনের তালিকা পাঠানো হয়েছে ইন্টারপোলে।

এর মধ্যে রয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন, তার স্ত্রী রুবিনা আক্তার, শেয়ারবাজার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ থাকা এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক লুৎফর রহমান বাদল, বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির। এর মধ্যে হঠাৎ করেই গত মাসে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন।

তিনি জামিন আবেদন করলেও আদালত তা নাকচ করে কারাগারে প্রেরণ করেন। প্রাথমিকভাবে সাতজনের তালিকা পাঠালেও দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ মার্চ মাসেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ৬০-৭০ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। যারা অর্থ পাচার ও আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত এবং দেশত্যাগ করেছেন তাদের ইন্টারপোলের সাহায্যে দেশে ফেরানো হবে।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের গত ১০ই মার্চ ইকবাল মাহমুদ বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে যারা কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে তাদের মধ্যে সাত-আটজনকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস ইস্যু করার অনুরোধ পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পলাতক থাকা আসামিদের মধ্যে আমরা ৬০-৭০ জনের নামের তালিকা প্রস্তুত করেছি।

পর্যায়ক্রমে সবার বিষয়ে রেড নোটিস ইস্যু করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ফেরত আনা হবে। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের কাছে প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক পরিচয় বলতে কিছু নেই। আমরা দেখি ব্যক্তির অপরাধ। সে যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে সে মন্ত্রী হোক বা এমপি হোক আমাদের কাছে বিবেচ্য নয়। দেশের অর্থ আত্মসাৎ করে, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করে বিদেশে আয়েশী জীবনযাপন করবে- সেটা হবে না।

এদিকে দুদক থেকে চিঠি পাঠানোর পর ইন্টারপোলের সাড়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো- এনসিবি-ইন্টারপোল শাখায়। পুলিশ সদর দপ্তরের এই শাখায় দায়িত্বরত মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম জানান, দুদক থেকে পাঠানো চিঠিটি তারা পেয়েছেন।

এ বিষয়ে ইন্টারপোলেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, এখান থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল, যারা দেশ থেকে টাকা নিয়ে গেছে তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। রেড নোটিস করার ক্ষেত্রে যে ডকুমেন্টসগুলো লাগে সবই দিয়েছি। এরপর ওরা আমাদের আর কোনো উত্তর দেয়নি। আমাদের ডকুমেন্টসগুলো পেয়ে ওরা বোধহয় কাজ করছে পরবর্তী আপডেটের জন্য।

দুদক প্রাথমিকভাবে সাতজনের তালিকা পাঠালেও সূত্রে জানা গেছে এই তালিকায় আরো যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ। তার বিরুদ্ধে জনতা ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রিমেক্স ফুটওয়্যারের নামে ৯৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাচারের অভিযোগ আছে।

তালিকায় আছেন যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, মোস্তফা গ্রুপের কর্ণধার হেফাজুতুর রহমান, ঢাকা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী টিপু সুলতান, বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার সাবেক প্রধান ও মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, অটো ডিফাইনের মালিক ওয়াহিদুর রহমান ও তার স্ত্রী,

বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাবিব, বিসমিল্লাহ গ্রুপের পরিচালক ও খাজা সোলায়মানের বাবা সফিকুল আনোয়ার চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকবর আজিজ মুতাক্কি, মহাব্যবস্থাপক আবুল হোসেন চৌধুরী, ব্যবস্থাপক রিয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, নেটওয়ার্ক ফ্রেইট সিস্টেম লিমিটেডের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন এবং জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা মোস্তাক আহমদ খান ও এসএম শোয়েব উল কবীর।

তালিকায় আরো রয়েছে টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জিনাত ফাতেমা, হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিং মিলসের মালিক আবদুল বাছির, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক জিয়াউর রহমান, আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, নকশী নিটের এমডি আবদুল মালেক ও সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামালউদ্দিন সরকার।

তালিকায় আছেন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের (বর্তমান আইসিবি ইসলামী ব্যাংক) সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মোহাম্মদ হারুন ও আবুল কাশেম আহমদ উল্লাহ, সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলুর রহমান ও মাহমুদ হোসেন, নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট কামরুল হোসেন, উপব্যবস্থাপক ইমামুল হক ও ব্যবসায়ী আবু বকর।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দুদকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অর্থ পাচার বা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বিদেশে অবস্থানের কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় পর্যায়ক্রমে চিঠি দিয়ে তাদের দেশে ফেরত আনার বিষয়ে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হবে।

-মানবজমিন

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.