শাহজালাল বিমানবন্দরের ৬০ শতাংশই অব্যবহহৃত

Shahjalal-International-Airportএভিয়েশন নিউজ: ধারণক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে দেশের প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। নতুন অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবহারের জন্য আরও ৬০ শতাংশ স্থান এখনও অব্যবহৃত রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, তা কাজে লাগিয়ে শাহজালালকেই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আদলে গড়ে তোলা সম্ভব। তেমনটি হলে ৫০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা খরচ করে নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ে তোলার কোনো প্রয়োজন নেই।

বিশ্লেষকদের মতে, শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরের অব্যবহৃত স্থানে অনায়াসেই দ্বিতীয় রানওয়ে গড়ে তোলা সম্ভব। পুরনো দুটি টার্মিনালকে আরও বহুতল ও আধুনিক করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে স্থাপন করা যেতে পারে প্রায় চারগুণ বড় আরও একটি টার্মিনাল। বাড়ানো সম্ভব বিমানবন্দরের ড্রাইভওয়েও। যদি সেসব করা হয়, শাহজালালের উড়োজাহাজ হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা বেড়ে যাবে বর্তমান ক্ষমতার চারগুণ। যার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার উড়োজাহাজ ওঠানামা করতে পারবে।

ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান চলাচল বৃদ্ধির পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ এখানে বছরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। ২০১৬ সালে তা ৩৫ হাজার এবং ২০২০ সালে ৫০ হাজার হতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ব্যস্ত সময়ে (পিক আওয়ার) ঘণ্টায় ঢাকায় বিমান ওঠানামা করবে গড়ে ২৫টি। ২০২০ সালে তা ৩৫ ও ২০২৫ সালে ৪৫টিতে উন্নীত হতে পারে। এয়ারলাইন্স বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ২০ বছরে যাত্রীসংখ্যা তিনগুণ বাড়তে পারে। তাতে বর্তমান সুবিধাদি ও রানওয়ে দিয়েই ২০৩০ সাল পর্যন্ত চালানো সম্ভব হবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ১৯৮১ একর জমি ঘিরে রয়েছে এ বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীর। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন) গ্র“প ক্যাপ্টেন নাজমুল আনাম জানান, প্রতি বছরই গড়ে প্রায় ৫ লাখ পর্যটক বাড়ছে। বাড়ছে এয়ারলাইন্সের সংখ্যাও। এতে শাহজালালের বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। একসঙ্গে চারটি উড়োজাহাজ নামলে তা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় এয়ারপোর্ট অথরিটিকে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই বেবিচক নতুন রানওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বর্তমান রানওয়ের সমান্তরালেই নতুনটি নির্মিত হবে। নির্মাণ করা হবে তৃতীয় টার্মিনাল। এতে করে শাহজালালে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের সংখ্যা বাড়বে।

দেশের এয়ারলাইন্সের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সব বিমানবন্দরের অভিভাবক বেবিচক। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বছরে ৬০ লাখ যাত্রী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করছে। প্রতি বছরই এ সংখ্যা গড়ে ৫ লাখ করে বাড়ছে। একইভাবে অভ্যন্তরীণ রুটেও যাত্রী বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ রুটে ৬ লাখের মতো যাত্রী ব্যবহার করছে দেশের প্রধান বিমানবন্দর। বেবিচক সূত্র জানায়, শাহজালালে বর্তমানে সামরিক ও বেসামরিক মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৪০টি উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। নতুন রানওয়ে, টার্মিনাল ও বোর্ডিং ব্রিজ নির্মিত হলে প্রায় এক হাজার উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ সম্ভব হবে।

বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, দুটি রানওয়ে ও ১টি টার্মিনাল নির্মাণ হলে তাতে আরও ৩২টি বোর্ডিং ব্রিজ যোগ হবে। বর্তমানে রয়েছে ২২টি। তখন মোট ব্রিজের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৪-তে। ইতিমধ্যে শাহজালালের বর্তমান রানওয়ের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। চলছে ট্যাক্সিওয়ে সংস্কারসহ সাড়ে ৫শ কোটি টাকার আপগ্রেডেশন অব শাহজালাল নামে ড্যানিস প্রকল্প। তা শেষ হলে ১৪ থেকে ২০ বছর আর সংস্কারের প্রয়োজন হবে না রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে। প্রায় দুই দশক আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের প্রধান বিমানবন্দরে দ্বিতীয় রানওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। পরে কাজটি আর এগোয়নি। তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উৎসাহেই বিমানবন্দর আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বাড়ানোর এই উদ্যোগ নেয়া হয়।

পাশাপাশি বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডেলিং কার্যক্রম জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাচ্ছে। তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট নিয়োগে ইতিমধ্যে আরএফপি (রিকোয়েন্ট ফর প্রপোজাল) আহ্বান করেছে বিমান। এ কোম্পানির কাজ হবে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং জয়েন্ট ভেঞ্চার করতে গাইডলাইন তৈরি ও দুপক্ষের জন্য দর নির্ধারণ করা। আরএফপি নীতিমালা তৈরি, নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নির্ধারণ, অপারেটিং সিস্টেম তৈরি, দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক, সংশ্লিষ্টদের ট্রেনিং ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের গাইডলাইনও তৈরি করবে প্রতিষ্ঠানটি। এটা করা হলে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের মানও বাড়বে।

বেবিচক জানায়, মাত্র ৩টি পার্কিং নিয়ে ১৯৮২ সালে হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর যখন যাত্রা শুরু করে তখন প্রতিদিন গড়ে ৬০টি উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করত। বর্তমানে পার্কিং সংখ্যা ৩৫টি। বেবিচকের পরিচালক (এটিএস) আজাদ জহিরুল ইসলাম জানান, ৫ বছর পর নতুন রানওয়ে ও টার্মিনাল ব্যবহার উপযোগী হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টির মতো বিমান ওঠানামা করলে সেটি স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলা যায়। শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে ব্যস্ত সময়ে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৪ থেকে ২০টি বিমান ওঠানামা করে। এর মধ্যে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের ওঠানামাও যুক্ত। অর্থাৎ ঢাকায় বর্তমানে তিন-চার গুণ বেশি বিমান ওঠানামা এবং যাত্রীর পরিমাণ দ্বিগুণ হলেও এর জন্য হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই যথেষ্ট। তাছাড়া আধুনিকায়নের মাধ্যমে এ বিমানবন্দরের ক্ষমতা-দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ তো রয়েছেই।

shahjalal-international-airportবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ অবস্থায় ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন বিমান বন্দর তৈরির কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই। সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ও সমীক্ষা করা হয়নি। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সিটি নামের একটি উপশহর গড়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান জয়নাল আবেদীন তালুকদার বলেন, এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ চলছে। প্রথম পর্যায়ে এখন ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সব সমীক্ষা করা হবে।

গত বছর প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্পটি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা কমিটি সাতটি স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করে তিনটি স্থানের নাম প্রস্তাব করে। জয়নাল আবেদীন তালুকদার নতুন বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন, দেশে এখন ১৯টি বিমান সংস্থা ফ্লাইট পরিচালনা করছে। শাহজালালে (রহ.) বিমান চলাচল বাড়ছে। ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে এর বর্তমান অবকাঠামো যথেষ্ট নয়। জয়নাল আবেদীনের দাবি, ক্ষমতার ৮০ শতাংশ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে।

এ বিমানবন্দরের রানওয়ে একটি এবং বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালন ক্ষমতা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিমানযাত্রীর তুলনায় তা অপ্রতুল। এই বিমানবন্দরের চারদিকে আবাসিক এলাকা ও সেনানিবাস থাকায় ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়। এর যাত্রী টার্মিনাল ভবন অপ্রশস্ত এবং পাঁচ স্তরের আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের যথেষ্ট সুযোগ নেই। এছাড়া বর্তমান বিমানবন্দরে সর্বশেষ প্রযুক্তির সুপরিসর উড়োজাহাজ এয়ারবাস এ-৩৮০ পরিচালনের ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ এবং এর সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ সড়ক এক্সপ্রেসওয়ে জরুরি।

তবে তার বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন সাহাব সাত্তার। তিনি বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত জমি ছিল। এখান থেকে রহস্যজনক কারণে বিমানবন্দও সংলগ্ন ১৩০ একর জমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেয়া হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এই জমি ইজারা দেয়, পরে তা বাতিলও করে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে আবার ওই সম্পত্তি ইজারা দেয় কান্ট্রি ক্লাব, গলফ ক্লাব, পাঁচ তারকা-তিন তারকা হোটেল ইত্যাদি করার নামে। বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি ওই জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাব করলেও রহস্যজনক কারণে তা এখনও বাতিল করা হচ্ছে না।

– মুজিব মাসুদ

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.