এভিয়েশন নিউজ: নিয়োগপ্রাপ্ত ৮ ক্যাডেট পাইলটকে আগামী ২৬ জুনের মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রয়োজন হলে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফটের জন্য প্রয়োজনীয় ঘণ্টা অতিরিক্ত ট্রেনিং কিংবা ওরিয়েন্টশান প্রোগ্রাম করিয়ে তাদের ফ্লাইটে পাঠানোর কথা বলেছে কর্তৃপক্ষ। ট্রেনিং না করিয়ে গত চার বছর কেন তাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানেরও নির্দেশ দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ট্রেনিং শেষ করা সারাওয়াত সিরাজ অন্তরা ও মুনজারিন রাইনকে সরাসরি ফ্লাইটে পাঠানোর জন্যও নির্দেশ দিয়েছে রেগুলেটরি কমিশন।
বেবিচক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ক্যাডেট পাইলট হিসেবে সারাওয়াত সিরাজ অন্তরা সিভিল এভিয়েশনের একজন লাইসেন্সধারী বোয়িং ৭৩৭ এয়ারক্রাফটের ফার্স্ট অফিসার। তার ট্রেনিং নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ফ্লাইট চলাকালীন একজন লাইন কাপ্টেনের অযৌক্তিক ও ঠুনকো কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে তার ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। লাইন ক্যাপ্টেন আদম চৌধুরীর রহস্যজনক অভিযোগটি নিয়েও বৈঠকে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হয়েছে, অন্তরার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আনার পেছনে ক্যাপ্টেন আদম চৌধুরীর অন্য কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল কিনা সেটা তদন্ত করা দরকার।
অপরদিকে মুনজারিন রাইনের সিমুলেটর ট্রেনিং ও বেইস ট্রেনিং শেষ হওয়ার পরও তার রুট ট্রেনিং না করানোর বিষয়টিও রহস্যজনক বলে মনে হয়েছে সিভিল এভিয়েশনের কাছে। এর পেছনেও অন্য কোনো রহস্য কিংবা খারাপ উদ্দেশ্য ছিল কিনা সেটাও তদন্ত করে দেখার জন্য বলেছে, সিভিল এভিয়েশন। ১৬ জুন (বুধবার) ১৮ ক্যাডেট পাইলট নিয়ে রেগুলেটরি কমিশন ও বাংলাদেশ বিমানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সিভিল এভিয়েশনের এফআই শাখার পরিচালক ক্যাপ্টেন আকরাম হোসেন বৈঠকের সত্যতা স্বীকার করে জানান, নিয়োগ দেয়ার পরও ৮ ক্যাডেট পাইলটকে ৪ বছর বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্তটি বিমানের জন্য আত্মঘাতী ছিল। তিনি বলেন, এরা যদি এখন ফ্লাইটে থাকত তাহলে বিমানের বৈমানিক সংকট থাকত না। তার মতে, ক্যাপ্টেন অন্তরা ও ক্যাডেট পাইলট মুনজারিনকে ফ্লাইট না দেয়া রহস্যজনক। তিনি বলেন, এরা দুজন তাদের ট্রেনিং সম্পন্ন করেছে।
সিভিল এভিয়েশনের একটি সূত্র জানায়, ৩ জুন যুগান্তরে বঞ্চনার জাঁতাকলে পিষ্ট ১৮ ক্যাডেট পাইলট শীর্ষক শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এরপরই বিমান বোর্ড সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। পরে সিভিল এভিয়েশন বিষয়টি নিয়ে বিমানের সঙ্গে বৈঠক করে।
বিমান এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক আহমেদ জানান, গত বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়, নিয়োগপ্রাপ্ত ৮ ক্যাডেট পাইলটকে বসিয়ে না রেখে কিভাবে বোয়িং-৭৩৭ এয়ারক্রাফটে ফ্লাইট করানো যায় সে বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের প্রয়োজনীয় মতামত নিতে। এ প্রেক্ষিতে দুপক্ষের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এখন বিমানের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে সিভিল এভিয়েশনের অনুমোদন নেয়া হবে। এরপরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে সিভিল এভিয়েশনের কড়া নির্দেশনায় নড়েচড়ে বসেছে বিমানের ট্রেনিং শাখা। জানা গেছে, তড়িঘড়ি করে তাই আগামী সোববার একটি ট্রেনিং সিডিউল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বেবিচকের অনুমোদনের জন্য। সূত্র জানায়, অনুমোদনের পরই অতিরিক্ত ট্রেনিংয়ের জন্য সিঙ্গাপুর কিংবা অন্যত্র পাঠানো হবে সংশ্লিষ্ট ক্যাডটে পাইলটদের।
সিভিল এভিয়েশনের এফআই (ফ্লাইট ইন্সপেকশন) শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, ক্যাডেট পাইলট অন্তরার বিরুদ্ধে বিমানের লাইন ক্যাপ্টেন আদম গত বছরের ৪ নভেম্বর যে রিপোর্ট দিয়েছে তার কোনোটিই সত্য ও যুক্তিসঙ্গত ছিল না। এ ধরনের কোনো রিপোর্ট দেয়ার ক্ষমতাও তার নেই। রিপোর্টের ধরন দেখলে বোঝা যায়, হয়তো রিপোর্টটি তাকে দিয়ে করানো হয়েছে কিংবা তিনি কোনো কারণে অন্তরার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে রিপোর্টটি তৈরি করেছেন।

রিপোর্টে অন্তরার বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও ফ্লাইট না করানোর মতো কোনো অভিযোগ ওই রিপোর্টে ছিল না বলে সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়। জানা গেছে, ওই ফ্লাইটে যাত্রী হিসেবে যাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন ইমামুল নামে একজন বৈমানিক। অভিযোগ উঠেছে, ক্যাপ্টেন আদম চৌধুরী অন্তরার ওপর এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন, তিনি অন্তরাকে ককপিট থেকে বের করে দিয়ে তার জায়গায় কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই যাত্রী হিসেবে যাওয়া ক্যাপ্টেন ইমামুলকে নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন।
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশনের (আইকাও) আইন অনুযায়ী এটি ভয়ঙ্কর অপরাধ। অথচ এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন আদমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর আগেও ক্যাপ্টেন আদম ডিসি-১০ এর সিমুলেটর পরীক্ষায় ফেল করেছি। পরে বিপুল অংকের টাকা গচ্চা দিয়ে তাকে পাস করিয়ে আনা হয়। এ বিষয়ে কথা বলতে বৃহস্পতিবার বিমানে গিয়ে আদমকে পাওয়া যায়নি। ফ্লাইট সিডিউল বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, ক্যাপ্টেন আদম ফ্লাইট নিয়ে দেশের বাইরে আছেন।
সিভিল এভিয়েশনের কনসাল্ট্যান্ট ও সাবেক একজন সিনিয়র পাইলট নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বিমানের নারী বৈমানিক ও এয়ারহোস্টেসরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, বিমানের বেশ কয়েকজন ক্ষমতাধর বৈমানিক আছেন যাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে কেবিন ক্রু ও নারী বৈমানিকরা ভয়ে তাদের ফ্লাইট পর্যন্ত বর্জন করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বিমান ছেড়ে পালিয়ে যেতে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট বৈমানিকদের কথামতো না চললে কিংবা তাদের কথা না শুনলে কোনো এয়ারহোস্টেস কিংবা মহিলা ক্যাডেট পাইলটকে ভালো ফ্লাইট কিংবা ইউরোপের কোনো দেশের ফ্লাইটে রাখা হতো না। তাদের অবাধ্য হলেই মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে হয়রানি করা হতো।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, ক্যাপ্টেন আদম চৌধুরী ক্যাডেট পাইলট অন্তরার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আনলেও খোদ আদমের বিরুদ্ধে আরও ভয়াবহ অভিযোগ সিভিল এভিয়েশনে জমা আছে। শুধু ক্যাপ্টেন আদমই নয়, বিমানের বহু সিনিয়র পাইলটের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ সিভিল এভিয়েশনে ফালইবন্দি হয়ে আছে। বিমানকে বাঁচাতে সিভিল এভিয়েশন শিগগিরই এসব অভিযোগ তদন্ত করে দেখবে বলেও জানা গেছে।
এদিকে ইন্তেখাব হোসাইন ও মুনতাসির মাহবুবকে কিভাবে ফ্লাইটে পাঠানো হয়েছে নিয়েও তদন্ত করবে বেবিচক। সূত্র জানায়, ২০১০ সালে বিমান ২০ জন ক্যাডেট বৈমানিককে নিয়োগ দেয়। এদের মধ্যে প্রথম ব্যাচের ১০ জনকে বিমানে যোগদান এবং দ্বিতীয় ব্যাচের ১০ জনকে ওয়েটিং ফর ফারদার ডিসিশন হিসেবে রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাডেট পাইলটদের ৬ মাসের ট্রেনিং নিতে হয়। শুধু সিমুলেটর ট্রেনিংসহ দুই মাসের ট্রেনিং হলেই এরা ফার্স্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাবেন। সেই অবস্থায় ১০ জনের মধ্য থেকে ৪ জনকে সিমুলেটরে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে ২ জনকে পাস ও ২ জনকে ট্রেনিং না করিয়ে ফেল করেছে বলে প্রচার করা হয়। পরে বাকিরাও ফেল করবে এই অজুহাত দিয়ে অন্যদের আর সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়নি।
জানা গেছে, নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচের ৮ ক্যাডেট বৈমানিক সিমুলেটর ট্রেনিং পাঠানোর জন্য পে-অর্ডার দিয়ে যেতে রাজি ছিলেন। যদি তারা সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে ফেল করেন তাহলে তারা ট্রেনিং বাবদ খরচ হওয়া অর্থ ফেরত দিতেও রাজি ছিলেন বিমানকে। বিমান সূত্রে জানা গেছে, বসে থাকা ক্যাডেটদের মধ্যে অনেকেরই ৫০০ ঘণ্টার বেশি ফ্লাইং করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর প্রত্যেকেরই ১৫০ ঘণ্টা ফ্লাই করার অভিজ্ঞতা আছে। কম ঘণ্টা ফ্লাই করা ক্যাডেটদের ট্রেনিংয়ে ২০ ঘণ্টার জায়গায় ২৫-৩০ ঘণ্টা এবং ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম করালেই তারা বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজের ফার্স্ট অফিসার হতে পারে।
– মুজিব মাসুদ