করোনা পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের ১২ লাখ প্রবাসী পরিবার এখন সংকটে। এদের কোন আয় না থাকায় চরম অর্থ কষ্টে পড়েছে প্রবাসী পরিবারগুলো। এদের মধ্যে লাখো প্রবাসী আটকা পড়েছে। যারা এখন আকাশ পানে চেয়ে আছে, কবে বিমান উড়বে আকাশে।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের খলিফাপাড়া গ্রামের প্রবাসী মো. সেলিম উদ্দিন ও নাজিম উদ্দিন। দুজনই সপরিবারে থাকেন ওমানে। করেন ব্যবসা। কিন্তু করোনা সংকট শুরুর আগে দেশে দুই মাসের ছুটিতে এসে এখন আটকা।
ওমানে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন বন্ধ, তেমনি দেশেও কোন কাজ নেই। ফলে দু‘মাস পর চরম অর্থসংকটে পড়ে তারা। কোনরকমে দিনাতিপাত করলেও এখন শুধু আকাশ পানে চেয়ে আছে কবে উড়াল দিবে তারা।
এদিকে সৌদি আরবের মক্কায় বসবাসকারী চট্টগ্রামের রাউজানের প্রবাসী আজগর হোসেন ফেসবুক মেসেঞ্জারে বলেন, গাড়ি চালাতাম আমি, কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারনে গত চার মাস ধরে গাড়ি চালানো বন্ধ। কোনো আয় নেই। বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছি না। কখন পাঠাতে পারব তাও জানি না। তিনি বলেন, শুধু আমার এমন দুরাবস্থা নয়, আমার পরিচিত শত শত মানুষ দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না।
নগরীর চান্দগাঁও থানার সমশের পাড়া এলাকার প্রবাসী মো. নাছিরের স্ত্রী উম্মে হাবিবা জানান, গত চার মাস ধরে স্বামী বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতে পারছে না। উল্টো তার জন্য টাকা পাঠাতে বলছে। এদিকে এক দেবর করোনা সংক্রমণের আগে বেড়াতে এসে আটকা পড়েছে। সবমিলিয়ে চরম অর্থ সংকটে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন তারা। অথচ তাদের এসব দেখার কেউ নেই।
চট্টগ্রামের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, যাদের পাঠানো অর্থে দেশের সকল ব্যবস্থা সচল ছিল, করোনা পরিস্থিতিতে এখন তারাই সবচেয়ে বেশি অচল হয়ে পড়েছে। করোনা মোকাবিলায় লকডাউনের মুখে পড়ে প্রবাসীদের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে রেমিট্যান্স আসা শূণ্যের কোটায় নেমে গেছে। দেশে এসে যারা আটকা পড়েছে আকাশপথ চালু না হওয়ায় তারা ফেরত যেতে পারছে না। এতে চরম দুরাবস্থার মুখোমুখি প্রবাসী পরিবারগুলো।
তিনি বলেন, আমাদের এক কোটি প্রবাসীর মাঝে পঞ্চাশ লাখেরও বেশি মানুষ রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। যেখানে অবস্থা নাজুক। এখান থেকে কয়েক লাখ মানুষ ফেরত আসবেন বা যারা এসেছেন তাদের আর যেতে দেবে না বলে শঙ্কা রয়েছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো খরচ সাশ্রয় করার জন্য অভিবাসীদের ফেরত পাঠাবে। নিজেদের বহু কাজ নিজেরাই করবে। এতে শুধু সাশ্রয় নয়, করোনার ঝুঁকিও তারা কমানোর চেষ্টা করবে; যার সরাসরি প্রভাব পড়বে প্রবাসী সেক্টরে।
তিনি বলেন, কয়েক লাখ প্রবাসী ফেরত আসার প্রভাব দেশের অর্থনীতিকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা সৃষ্টি করে; যা মুখ থুবড়ে পড়বে। বিপুল সংখ্যক প্রবাসী পরিবার আর্থিক কষ্টে পড়বে। বেরকারত্ব বেড়ে যাবে। এদের নিয়ে এখনই চিন্তা করতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১৫ হাজার মানুষ নতুন ভিসায় বিদেশ যান। এদের বেশিরভাগই যান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, হংকংসহ নানা দেশে প্রচুর লোকজন কাজে যান। কিন্তু গত চার মাসে চট্টগ্রাম থেকে একজন মানুষও চাকরি নিয়ে বিশ্বের কোনো দেশে যাননি।
এছাড়া দেশে এসে আটকা পড়েছেন অন্তত ১ লাখ প্রবাসী। এদের কেউই কাজে ফিরতে পারছেন না। অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অনেকের বিমানের টিকেটের সময় চলে গেছে। এসব নিয়ে উদ্বেগের মাঝে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
অবশ্য কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, বিমানের টিকেট বাতিল হবে না। ফ্লাইট চালু হলে এসব টিকেট নিয়ে কাজে যাওয়া যাবে। আবার ভিসা নিয়েও সমস্যা হবে না। যাদের ভিসা ছিল সেগুলোর মেয়াদ বাড়িয়ে কাজে যোগ দেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মনোভাব এখনো পরিষ্কার নয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গত চার মাসে জনশক্তি রপ্তানি শূন্যের কোটায় নেমে আসায় অনেক পরিবারে দুর্যোগ নেমে এসেছে। চড়া দামে ভিসা কিনেও কাজে যেতে পারছেন না অনেকে। এদের অনেকের আয়-রোজগার নেই বললেই চলে। আবার বিদেশ থেকে এসে আটকা পড়া বিপুল সংখ্যক মানুষ ফিরতে পারছেন না। এদেরও কোনো আয় নেই। তারা আছেন অর্থ সংকটে।
অন্যদিকে বিদেশে কাজ বা ব্যবসা করতে না পারায় হাজার হাজার মানুষ দেশে টাকা পাঠাতে পারেননি। প্রবাসীদের পাঠানো টাকার ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোও আর্থিক কষ্টে পড়েছেন। চট্টগ্রামের অন্তত ১২ লাখ পরিবার কম-বেশি সংকটে পড়েছেন।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক চট্টগ্রাম মহানগর জুবিলী রোড শাখার ব্যবস্থাপক সরদার মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, করোনাকালে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা আসার পরিমাণ বহুলাংশে কমে গেছে। আগে যেখানে ৩০-৪০ জন প্রবাসী পরিবার রেমিটেন্সের জন্য আসতো, সেখানে এখন ২-৩ জন আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামের প্রবাসীরা প্রতি মাসে গড়ে ৬০০ কোটি টাকার মতো রেমিটেন্স পাঠাতেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা একেবারে কমে গেছে। গত চার মাসে তা অর্ধেকে নেমে আসার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
প্রকাশ, মানবজমিন, ২৭ জুন ২০২০