মো. সাইফুল্লাহ : প্রথমবার জায়গাটায় গেলে নির্ঘাত আপনার পিলে চমকে যাবে! একটু পর পর মাথার ওপর দিয়ে উড়োজাহাজ উড়ে যায়; এতটাই নিচ দিয়ে, মনে হয় এই বুঝি মাথার ওপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। ছোট ছোট বাতি জ্বালানো রানওয়ে, বিমানের ল্যান্ডিং, সবটাই চমৎকার দেখা যায়। জায়গাটার নাম দলিপাড়া। ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এদিককার সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল ‘পাগলা পাইলটের’ সঙ্গে। তাঁর নাম কারিব আহমেদ। আশপাশের লোকজন পাগলা পাইলট বলে ডাকলেও তিনি মূলত একজন স্পটার।
স্পটার! সে আবার কী জিনিস? আপনার মতো একই প্রশ্ন জেগেছিল আমাদের মনেও। সহজ উত্তর হলো, যিনি স্পটিং করেন তিনিই স্পটার।
নাহ্, এখনো বোঝা গেল না, তাই তো? বুঝিয়ে বললেন আরেক স্পটার ফয়সাল আকরাম, ‘সহজ ভাষায় স্পটিং হচ্ছে একধরনের শখ। পাখিপ্রেমীরা যেমন বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখেন, ছবি তোলেন। স্পটিংটাও অনেকটা সে রকম। তবে এই পাখি হলো যান্ত্রিক পাখি, উড়োজাহাজ। স্পটাররা মূলত বিভিন্ন ধরনের উড়োজাহাজের গায়ে লেখা নিবন্ধন নম্বর সংগ্রহ করেন, ছবি তোলেন। নতুন নতুন উড়োজাহাজ দেখাই তাঁদের নেশা। আন্তর্জাতিকভাবে এই শখ বেশ প্রচলিত।’ ভাবছেন নতুন উড়োজাহাজ দেখা, নিবন্ধন নম্বর সংগ্রহ আর ছবি তোলা—এ আর এমন কী? আমাদেরও এমনটাই মনে হয়েছিল। বিস্তারিত শুনে আক্কেলগুড়ুম!
ওই যে উড়োজাহাজ
কারিব আহমেদের বয়স তখন তিন কি চার। উড়োজাহাজ বলতে অজ্ঞান সেই ছেলেবেলা থেকেই। বিমানের শব্দ শুনলেই ছুটে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেন। ছোট ছোট খেলনা বিমানে ভর্তি কারিবের বাসাটাই হয়ে উঠেছিল একটা আস্ত ‘বিমানবন্দর’। সে সময় ছোট্ট কারিবকে খাওয়ানোটাও ছিল একটা ঝক্কির ব্যাপার। বিমান না দেখলে তাঁর মুখ দিয়ে খাওয়া ঢুকত না। বাধ্য হয়ে মা তাঁকে নিয়ে গাড়িতে বিমানবন্দরের আশপাশে ঘুরঘুর করতেন। সুযোগ বুঝে এক-দু চামচ করে খাওয়ানো হতো। মা-বাবা ভাবতেন ছোট মানুষ, বড় হলে হয়তো এই উড়োজাহাজ-প্রীতি কমবে। কমল তো না-ই, বরং বাড়ল। কারিবের তখন নয়-দশ বছর বয়স। ‘আম্মু বিভিন্ন কাজে মাঝেমধ্যে ভারতে যেতেন। আমিও যেতাম। ঘোরাঘুরি নয়, বিমানবন্দরে কিছুক্ষণ থাকা আর প্লেনে চড়া, এইটুকুর জন্যই যেতাম। যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যেতাম, আবার গিয়েই ফেরার জন্য পাগল!’ বলছিলেন কারিব। তিনি তখন বিমানের যাত্রীদের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করতেন। টিস্যু, খাবার, ম্যাগাজিন…। বিমানের একটি ম্যাগাজিন পড়েই একদিন জানলেন স্পটিংয়ের খবর। ’৯৩ সালের কথা। কারিবের মাথায় স্পটার হওয়ার ভূত চাপল। খাতা-কলম আর দুরবিন নিয়ে দলিপাড়ায় হাজিরা দিতে শুরু করলেন। দুরবিন দিয়ে বিমানের গায়ে লেখা নিবন্ধন নম্বর দেখে নিয়ে চট করে খাতায় টুকে নিতেন।
একসময় জানলেন, শুধু নিবন্ধন নম্বর সংগ্রহ করলেই হয় না। স্পটিংয়ের কিছু নির্দিষ্ট নিয়মরীতি আছে। ছবি তুলতে হয়, নির্দিষ্ট একটা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হয়। কারিব এবার উঠেপড়ে লাগলেন। রাত-দিন ক্যামেরা নিয়ে পড়ে থাকতেন দলিপাড়ায়। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন একজন পুরোদস্তুর স্পটার, এলাকার মানুষের কাছে ‘পাগলা পাইলট’।
আগুন পাখির পিছু
ছোটবেলার কারিব এখনো বদলাননি। উড়োজাহাজের শব্দ শুনলেই আর কোনো হুঁশ থাকে না। বছর দেড়েক আগে কারিবের সঙ্গে যোগ হয়েছেন আরেক উড়োজাহাজ-প্রেমী ফয়সাল আকরাম। ফয়সাল একজন আলোকচিত্রী। ফেসবুকের মাধ্যমে কারিবের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জেনে ফয়সালের মনে হলো, ‘আরে! এমন একটা কিছুই তো খুঁজছিলাম!’ দলিপাড়ায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল কারিব আর ফয়সালের সঙ্গে। একটু পর পর বিকট শব্দে মাথার ওপর দিয়ে বিমান যায়, কারিব আর ফয়সাল সঙ্গে সঙ্গে কথা থামিয়ে বিমান দেখতে ছুটে যান। ‘আরি! আরেকটা ট্রিপল সেভেন!’ দুই স্পটার সবকিছু ভুলে নিজেদের কাজে মত্ত হয়ে যান। কী কী যে বলেন, শুনতে হিব্রু ভাষার মতো লাগে! বিমান উধাও হতেই আবার ফিরে আসেন, ‘ওহ্ স্যরি ভাইয়া, কী যেন বলছিলাম?’
কারিব বলছিলেন থাই এয়ারওয়েজের একটা বিমানের গল্প। ‘একবার থাই এয়ারওয়েজের একটা বিমান ল্যান্ড করতে গিয়ে ক্র্যাশ করল। খবর পেয়েই আমি ছুটে এলাম ছবি তোলার জন্য। দেখি কাউকে ধারে-কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। খবর পেলাম ১০ মিনিটের মধ্যে কক্সবাজারের উদ্দেশে একটা বিমান যাবে। ভাবলাম, টিকিট কেটে ফেললে ভেতরে ঢুকতে পারব। রানওয়ে থেকে ছবিও তোলা যাবে। ঝটপট টিকিট কেটে ফেললাম। পরে প্লেন থেকে আমি ছবিটা তুলতে পেরেছিলাম।’ কারিবের তোলা সেই ছবি পরবর্তী সময়ে দেশি-বিদেশি বহু পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এক ফাঁকে ফয়সাল হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘কারিব ভাই, সেভেন ফোর সেভেনটার কথা মনে আছে?’ মনে পড়তে কারিবও হাসলেন। আমাদের কাছে খোলাসা করলেন হাসির কারণ, ‘তখন হজ ফ্লাইট চলছিল। রাতের বেলা খবর পেলাম, বিশাল একটা সেভেন ফোর সেভেন প্লেন আসবে রাত চারটার সময়। আমরা দুজন সেই মাঝরাতে এই রাস্তায় এসে হাজির। সেই প্লেন এসেছিল ভোর সাড়ে ছটার সময়!’ কারিব আর ফয়সাল বলছিলেন, স্পটিং শুধু একটি শখ নয়। এটি ইতিহাস ধারণ করে। কথায় কথায় কারিব জানালেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম স্পটার কিন্তু আমি না। আজিজুল ইসলাম ভাই। তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন। সেই সত্তরের দশক থেকে তিনি স্পটিং করেন। তাঁর কাছে বাংলাদেশের অনেক পুরোনো বিমানের দুর্লভ সব ছবি আছে। আজিজ ভাই আমাকে দারুণ সাহায্য করেছেন। তিনি না থাকলে এত দূর আসা হতো না।’
এত দূর মানে কত দূর? কারিব আর ফয়সাল জানালেন তাঁদের সাফল্যের কথা। www.jetphotos.net নামে একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের সব নামীদামি স্পটার আর অ্যাভিয়েশন ফটোগ্রাফাররা উড়োজাহাজের ছবি আপলোড করেন। যেকোনো ছবিই আপলোড হয় না। ছবির মান ভালো হতে হয়, কিছু ক্যাটাগরিও পূরণ করতে হয়। এই ওয়েবসাইটে কারিব আর ফয়সালের তোলা বেশ কিছু ছবি আছে। ফেসবুকে কারিবদের একটি গ্রুপও আছে, ‘বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন হাব’ নামে। যাঁরা স্পটিংয়ে আগ্রহী, চাইলে এই গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন। ‘ আমার জানামতে, বাংলাদেশিদের মধ্যে অ্যাকটিভ স্পটার বলতে আজিজ ভাই, আমি, ইথার ভাই (ফয়সাল আকরাম) আর আছেন তানভীর ভাই। আমরা চাই এই সংখ্যাটা আরও বাড়ুক।’ বলছিলেন কারিব।
দিনে-রাতে, রোদে-বৃষ্টিতে দলিপাড়ায় পড়ে থেকে বিমান দেখেন বলে কারিব এলাকার লোকজনের কাছে পাগলা পাইলট নাম পেয়েছেন। তবে স্কলাস্টিকা থেকে ও-লেভেল, এ-লেভেল করা কারিবকে খুব শিগগির দেখা যাবে সত্যিকার পাইলট হিসেবে। আপাতত একজন শিক্ষানবিশ পাইলট তিনি। ফয়সাল চাকরি করছেন একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে। ‘অফিসে আমার ডেস্কটা নিয়েছি জানালার পাশে। যেন শব্দ পেলেই প্লেন দেখার জন্য ছুটতে পারি।’ বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে স্পটার আছে, একসময় ভিনদেশি স্পটাররা তা জানতেনও না। জেটফটোজ ডট নেটে ছবি দেখে, ফেসবুকের মাধ্যমে কারিবদের কথা জেনেছেন তাঁরা। ভিনদেশি স্পটাররা অনেকেই বাংলাদেশে বেড়িয়ে গেছেন। আসার আগেই কারিবদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। কারিবও তাঁদের আতিথেয়তার ভার নিয়েছেন। ‘গত ১০ বছরে প্রায় শতাধিক বিদেশি স্পটার এসেছেন, যাঁদের সঙ্গে আমি গাইড হিসেবে কাজ করেছি। আমি দেশের বাইরে গেলেও বিদেশি স্পটাররা অনেক সাহায্য করেন। বিদেশি স্পটাররা মূলত আসেন ডিসি-টেন দেখার জন্য। ডিসি-টেন বাংলাদেশের অনেক পুরোনো একটা যাত্রীবাহী প্লেন, আমার কাছে এই প্লেনটা বন্ধুর মতো…!’ বলতে বলতেই বিমানের শব্দ। কারিব আর ফয়সাল আবার ছুটে গেলেন বিমান দেখতে। ‘ওহ্, রিজেন্টের…’ শুরু হয়ে গেল তাঁদের ‘হিব্রু ভাষা’!
স্পটিং তথ্যকণিকা
l ধারণা করা হয়, প্লেন স্পটিংয়ের সূচনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে। তবে অনেকের মতে, ‘ট্রেন স্পটিং’ থেকে ‘প্লেন স্পটিংয়ের’ শুরু।
l প্রতিটি বিমানের গায়ে ভিন্ন ভিন্ন ‘টেইল নম্বর’ থাকে, যার মাধ্যমে বিমানটি শনাক্ত করা যায়। স্পটাররা মূলত টেইল নম্বর সংগ্রহ করেন।অনেক স্পটার বিমানের শব্দ শুনেই নাম, প্রকার, ইঞ্জিনের সংখ্যা ইত্যাদি বলে দিতে পারেন।
l বিশ্বের অনেক দেশে স্পটারদের জন্য আলাদাভাবে বিমান প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
l যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে স্পটাররা বিমানবন্দরের গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগী হিসেবেও কাজ করেন।