২৪০ বছরে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পেল যুক্তরাষ্ট্র

c50e433f08c077c8b012fd1cdd2250f0-1-1-2016-07-27T001311Z_418216948_TM3EC7Q1JO101_RTRMADP_3_USA-ELECTION-CLINTONযুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনে গত মঙ্গলবার রাতে এক ইতিহাস সৃষ্টি হলো। সম্মেলনে হিলারি ক্লিনটনকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিল তাঁর দল। আর এর ফলে দেশটির ২৪০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নারী কোনো প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলেন। এ বছরের
নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়বেন। সম্মেলনস্থলে থাকা ২০ হাজার মানুষের উচ্ছ্বাস, মুহুর্মুহু করতালি ও চিৎকারের মধ্যে এই মনোনয়নের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর সেখানে বড় পর্দায় দেখানো হয় হিলারি ক্লিনটনের ভিডিও বার্তা। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, আমাদের সামনে থাকা সেই কাচের দেয়ালটিতে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় চিড় ধরিয়েছি আমরা।…সম্মেলনের বাইরে ছোট মেয়েরা যদি এটি দেখে, তবে তাদের আমি বলছি, আমি হয়তো প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হব। কিন্তু এর পরই তোমাদের মতো কেউ একজন আছে।’
নারীদের পথে বিভিন্ন অদৃশ্য বাধার কথা বোঝাতে আগেও কাচের দেয়ালের উপমা দিয়েছেন সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি।ডেমোক্রেটিক কনভেনশনের প্রথম দিন সম্মেলনকক্ষের ভেতরে ও বাইরে অব্যাহত প্রতিবাদের মুখে দলীয় ঐক্য ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। দ্বিতীয় দিনেও ‘রোল কল’ ভোটের সময় বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। শেষ পর্যন্ত বার্নি স্যান্ডার্সের অল্প কিছুসংখ্যক সমর্থক হিলারির মনোনয়নের প্রতিবাদে সরবে সম্মেলনকক্ষ ছেড়ে চলে গেলেও বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটেনি। তবে সম্মেলনকক্ষের বাইরে সারা দিন ধরে পক্ষে-বিপক্ষে একাধিক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। নিজেদের মধ্যে ও পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। তবে হিলারির মনোনয়ন ঘোষণার ঐতিহাসিক ঘটনা দলের সমর্থকদের মধ্যে যে আনন্দ-উল্লাসের সঞ্চার করে, তাতে সব প্রতিবাদ স্তিমিত হয়ে যায়।

২০০৮ সালে হিলারি ক্লিনটন প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর দলের মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেবার ১ কোটি ৪০ লাখ ভোট পাওয়ার পরও বারাক ওবামার চ্যালেঞ্জের মুখে তাঁকে লড়াই থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নারীসমাজ দীর্ঘদিন একজন নারী প্রার্থীর জন্য অপেক্ষায় থেকেছে। তারা সেবার খুব খুশি মনে হিলারির প্রস্থান মেনে নেয়নি। সেদিন অসন্তোষ প্রকাশের বদলে হিলারি নিজে দলের একমাত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের জন্য ওবামার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। এবার ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের ‘রাজনৈতিক বিপ্লবের’ কারণে তাঁর প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত স্যান্ডার্সই তাঁকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন, তাঁর সমর্থকদের প্রকাশ্য প্রতিবাদের মুখে তিনি হিলারিকে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের প্রস্তাব করেন।

কোনো অঘটন ছাড়া দলীয় ঐক্য অক্ষুণ্ন রেখে হিলারির মনোনয়ন নিশ্চিত করতে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বকে পর্দার অন্তরালে স্যান্ডার্স ও তাঁর সমর্থকদের সঙ্গে সমঝোতায় বসতে হয়। স্যান্ডার্সের চাপে দলীয় নির্বাচনী কর্মসূচিতে এই স্বঘোষিত সমাজতন্ত্রীর বিভিন্ন বাম-ঘেঁষা দাবিদাওয়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দলীয় প্রধান কংগ্রেসওম্যান ডেবি ওয়াসারম্যান শুলজ হিলারির পক্ষ নিয়ে স্যান্ডার্সের মনোনয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন, এই অভিযোগের মুখে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তাতেও স্যান্ডার্স-সমর্থকদের ক্ষোভ প্রশমিত না হলে ডেমোক্রেটিক পার্টির তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া হয়। স্যান্ডার্সের দাবির মুখেই ধ্বনি ভোটে হিলারির মনোনয়ন ঘোষণার বদলে ‘রোল কল’ ভোটের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিদল তাদের আসন থেকে হিলারি ও স্যান্ডার্সের পক্ষে কে কত ডেলিগেট ভোট দিচ্ছেন, সে কথা প্রকাশ্যে ঘোষণার সুযোগ লাভ করে।

‘রোল কল’-এর শেষ ভোটটি ঘোষণা করেন স্যান্ডার্স নিজে। ভারমন্টের রাজ্য প্রতিনিধিদলের পক্ষে তিনি হিলারি ক্লিনটনকে দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তাব করেন।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিভিন্ন বক্তা হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে অনেক যোগ্য তার ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের হাতে নিহত বিভিন্ন আফ্রিকান আমেরিকান।

দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বক্তা ছিলেন হিলারি ক্লিনটনের স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। প্রায় ৪০ মিনিট স্থায়ী ভাষণে তিনি হিলারির ব্যক্তিগত পরিচয় তুলে ধরেন। বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত হিলারি অধিকাংশ মার্কিনির কাছে অজ্ঞাত। সেই শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে বিল ক্লিনটন তাঁর ৪০ বছরের বিবাহিত জীবনের ব্যক্তিগত ও ঘনিষ্ঠ বিবরণ তুলে ধরেন। অসংখ্য জানা-অজানা ঘটনা তুলে ধরে তিনি ‘পরিবর্তনের পক্ষে’ হিলারির অক্লান্ত চেষ্টার সবিস্তার ইতিহাস তুলে ধরেন। ক্লিনটন বললেন, প্রথম দেখায়ই তিনি হিলারির প্রেমে পড়েছিলেন। একবার নয়, তিনবার প্রস্তাব করার পর হিলারি তাঁকে বিয়ে করতে সম্মত হন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকার সময় থেকেই হিলারি নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে গেছেন। ক্লিনটন বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে হিলারি পরিবর্তনের পক্ষে তাঁর লড়াই চালিয়ে যাবেন। মুহুর্মুহু করতালি ও সোল্লাস চিৎকারের মাধ্যমে সম্মেলনকক্ষের প্রায় ২০ হাজার দর্শক এই সময় বিল ক্লিনটনের বক্তব্যের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানান। বিল ক্লিনটন বলেন, ‘হিলারি ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে জনসেবার একেবারে ভিন্ন এক জগৎ সম্পর্কে আমার চোখ খুলে দেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এত দিন তাঁদের ফার্স্ট লেডির কথা শুনে এসেছেন। নভেম্বরের নির্বাচনে হিলারি জয়ী হলে বিল ক্লিনটন হবেন নারী প্রেসিডেন্টের স্বামী হিসেবে এ দেশের ইতিহাসে প্রথম ‘ফার্স্ট জেন্টলম্যান’।

মঙ্গলবারের কনভেনশনে আরেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তা ছিলেন হলিউডের খ্যাতনামা অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ। যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার আদলে পোশাক পরে আলো-ঝলমল কনভেনশন মঞ্চে আসেন তিনি। মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে বক্তব্য দেন ২০ মিনিট। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে হিলারির মনোনয়নে আপ্লুত স্ট্রিপ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের ভোটাধিকারের প্রায় ১০০ বছর পর আপনারা এক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।’ তিনি বলেন, ‘নভেম্বর মাসে হিলারি ক্লিনটনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করবেন আপনারা। তিনি হবেন আমাদের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট এবং তিনি হবেন মহৎ এক প্রেসিডেন্ট। তিনি হবেন প্রথম, কিন্তু শেষ নন। তিনি সাহস ও সাবলীলভাবে নিয়ে দেশের সেবা করে যাবেন।’

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.