গত সোমবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এসকিউ৩২১ লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ২১১ জন যাত্রী ও ১৮ জন ক্রু নিয়ে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। উড়োজাহাজটি মাঝ আকাশে মারাত্মক টার্বুলেন্সের শিকার হয়ে এক যাত্রীর মৃত্যু ও বেশ কয়েকজন আহত হয়।
কিন্তু নির্দিষ্ট গন্তব্য থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টার দূরত্বে থাকার সময় বঙ্গোপসাগরের উপর মাঝ আকাশে সেটি টার্বুলেন্সের শিকার হয়। তখন পাইলট ঘুরে গিয়ে ব্যাংককের সূবর্ণভূমি বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের অনুমতি চান।
এরপর বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর উড়োজাহাজটি ব্যংকক সময় মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৪টার দিকে সূবর্ণভূমি বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে।
এই ঘটনার পর অনেকের মনে নিশ্চয়য়ই প্রশ্ন জেগেছে যে, এয়ার টার্বুলেন্স কী ও কেন হয়?
উড়োজাহাজে ঘন ঘন যাতায়াত করা যাত্রীরা হঠাৎ ঝাঁকুনির সঙ্গে পরিচিত। মূলত উড়োজাহাজ টার্বুলেন্সের মুখোমুখি হলে এমন হয়। টার্বুলেন্স বলতে বায়ুর একধরনের অনিয়মিত প্রবাহকে বোঝায়, যা দুই বিপরীতমুখী বাতাসের সংঘর্ষের কারণে তৈরি হতে পারে।
বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহের এই ধাক্কাধাক্কির মধ্যে উড়োজাহাজ এসে পড়লেই এক বা একাধিক মারাত্মক ঝাঁকুনি লাগতে পারে। উড়োজাহাজের গতিবিধি ও উচ্চতায় ঘটতে পারে আকস্মিক পরিবর্তন। এক ধাক্কায় উড়োজাহাজ কয়েক হাজার ফুট নীচে নেমে যেতে পারে।
কোনো সংকেত ছাড়াই এমনটা হয়। বাতাসের চাপ খুব বেশি থাকলেও উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আগে থেকে আন্দাজ পাওয়া যায়না বলে পাইলটদের কাছে এ ধরনের ঘটনা অপ্রত্যাশিত।
রয়্যাল এয়ার ফোর্সের সাবেক কর্মকর্তা ও বিবিসি ওয়েদারের সাইমন কিংয়ের মতে, বেশিরভাগ টার্বুলেন্স মেঘের রাজ্যে ঘটে থাকে। কেননা সেখানে ঊধ্র্বমুখী ও নিম্নগামী বায়ুপ্রবাহ থাকে।
গরম বাতাস উপরে ওঠা এবং ঠান্ডা বাতাসের সেই শূন্যস্থান পূরণ- এই দুই বাতাসের গতি ও অভিমুখ ভিন্ন। বিপরীতমুখী এ দুই বায়ুপ্রবাহ অনেক সময় এলোমেলোভাবে বয়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হয় ঘূর্ণি। এটিই এয়ার টার্বুলেন্স ঘটার কারণ।
বাতাসের এই এলোমেলো প্রবাহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মোটামুটি হালকা থাকলেও বড় মেঘের ক্ষেত্রে তা মাঝারি এমনকী গুরুতর টার্বুলেন্সও সৃষ্টি করতে পারে। উড়োজাহাজ আকাশে মেঘের বুক চিরে যাওয়ার সময় সাধারণত এই টার্বুলেন্স ঘটে।
তবে টার্বুলেন্স নানা ধরনের হতে পারে। তার মধ্যে একটি হল: ‘ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্স’; যা ঘটে থাকে পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশে। এই টার্বুলেন্স উড়োজাহাজের ওয়েদার রাডারে ধরা পড়ে না। ফলে তা শনাক্ত করা খুবই কঠিন। আর এ কারণেই এই টার্বলেন্স বিপজ্জনক।
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ ও পাইলট গাই গ্র্যাটন বলেন, ‘এ ধরনের টার্বুলেন্স পৃথিবীর জেট স্রোতের চারপাশে ঘটে। দ্রুতগতিতে প্রবাহিত বাতাসের এই স্রোত সাধারণত ৪০ থেকে ৬০ হাজার ফুট উচ্চতায় পাওয়া যায়’।
তিনি বলেন, ‘আপনি সহজেই জেট স্রোতের বাতাস এবং আশেপাশের বাতাসের মধ্যে ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতির ফারাক পাবেন। ধীর ও দ্রুত গতির বাতাসের মধ্যে জেট স্রোতের চারপাশে ঘর্ষণ টার্বুলেন্স সৃষ্টি করে’। শক্তিশালী বায়ুস্রোত চারপাশে প্রবাহিত হয়। ফলে তা এড়ানো কঠিন হয়ে যায়।
উদাহরণ দিয়ে গ্র্যাটন বলেন, আপনি যদি ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় উড়োজাহাজে করে যান, তবে এই বায়ুস্রোত পুরোপুরি এড়ানো কঠিন। এর ফলে কখনও কখনও মারাত্মক টার্বুলেন্সের সৃষ্টি হতে পারে।
টার্বুলেন্স কতটা বিপজ্জনক?
ক্র্যানফিল্ড ইউনিভার্সিটির ‘অ্যাভিয়েশন এন্ড দ্য এনভাইরনমেন্ট’ এর সহযোগী অধ্যাপক গ্র্যাটন বলেছেন, ‘টার্বুলেন্স যতটা খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে সেটি সহ্য করে নেওয়ার মতো করেই উড়োজাহাজগুলো বানানো হয়। তাই টার্বুলেন্সের কারণে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে’।
তবে টার্বুলেন্স উড়োজাহাজের জন্য ভাল কিছুও বয়ে আনে না। তাই পাইলটরা এ পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরম পরিস্থিতিতে টার্বুলেন্স একটি উড়োজাহাজের কাঠামোগত ক্ষতি করতে পারে। বাতাস কতটা শক্তিশালী হয় তার ওপর এটি নির্ভর করে।
প্রবল টার্বুলেন্স বিমানের যাত্রীদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। ঝাঁকুনি যদি তীব্র বা অতি তীব্র হয় তাহলে নানা বিপদ ঘটতে পারে। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেক নিচে নেমে যেতে পারে বিমান।
তখন প্রচণ্ড ধাক্কায় আঘাত লাগতে পারে যাত্রীদের, মাথা ফেটে যেতে পারে, কেউ সিটবেল্ট না পরে থাকলে কেবিনে আছড়ে পরতে পারেন। এমনকী, বিমানের তীব্র ঝাঁকুনির কারণে যাত্রী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। যদিও বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, টার্বুলেন্সে যাত্রী হতাহতের ঘটনা ঘটা বিরল ব্যাপার।
জন স্ট্রিকল্যান্ড নামের এক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ জানান, লাখ লাখ ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে গুরুতর টার্বুলেন্স থেকে মৃত্যুর ঘটনা ‘তুলনামূলকভাবে বিরল’।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড জানায়, ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ইউএসভিত্তিক এয়ারলাইন্স ১৬৩টি ‘গুরুতর টার্বুলেন্স’ এর শিকার হয়েছে, যা প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১২টি।
পাইলটরা যেভাবে টার্বুলেন্স মোকাবিলা করেন
পাইলটরা রওনা দেওয়ার আগেই যাত্রা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস পান; যার মধ্যে আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যও থাকে। ফলে তারা নিজেদের রুট পরিকল্পনা করার সময় এই তথ্য খতিয়ে দেখে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তারা মূলত বিচ্ছিন্ন কিছু বজ্রঝড় এড়াতে সক্ষম হতে পারেন। কিন্তু ‘ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্স’ এড়ানো কঠিন।
অধ্যাপক গ্র্যাটন বলেন, একই রুটে আগেই যাত্রা করা অন্যান্য উড়োজাহাজগুলো কোনো টার্বুলেন্সের বিষয়ে রিপোর্ট করে থাকে। সেক্ষেত্রে পাইলটরা ঐ এলাকাগুলো এড়াতে চেষ্টা করে বা টার্বুলেন্সের ধাক্কায় ক্ষয়ক্ষতি কমাতে উড়োজাহাজের গতি কমিয়ে দেয়। তাছাড়া, এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্রুদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
নিরাপদ থাকার জন্য যাত্রীরা যা করতে পারেন
টার্বুলেন্স পরিস্থিতিতে যাত্রীদের জন্য উপদেশ হলো সিটবেল্ট ব্যবহার করা এবং কোনো ভারি জিনিস বাইরে না রাখা। এক্ষেত্রে পাইলটরা যাত্রীদের সব সময় সিটবেল্ট পরে থাকার পরামর্শ দেন। কারণ, টার্বুলেন্স কখন ঘটবে তা জানা থাকে না।
টার্বুলেন্সের প্রবণতা কি বাড়ছে?
কিছু গবেষক মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে টার্বুলেন্সের প্রবণতা বেড়েছে।
গত বছর যুক্তরাজ্যের রিডিং ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, সাধারণত ব্যস্ত নর্থ আটলান্টিক রুটে ১৯৭৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মারাত্মক টার্বুলেন্স ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।
একইসঙ্গে কার্বন নিঃসরণ থেকে সৃষ্ট উষ্ণ বাতাসের কারণে অনেক উচ্চতায় বাতাসের গতির পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
অধ্যাপক গাই গ্র্যাটন মনে করেন, আমরা বেশি বেশি টার্বুলেন্সের মুখে পড়ছি। এর আরেকটি কারণ হতে পারে আমরা বেশি বেশি বিমানভ্রমণ করছি।
সূত্র: বিবিসি