বিমানের ইঞ্জিন পুড়ে শত কোটি টাকা ক্ষতি – তদন্তের সব ফাইল মন্ত্রণালয়ে তলব

burn aircraftবাংলাদেশ বিমানের ইঞ্জিন পুড়ে শত কোটি টাকা ক্ষতির বিষয়টি তদন্ত করবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে এ ঘটনায় এর আগে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন, ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি, ওভারহোলিং কোম্পানি ও যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিন পরীক্ষার রিপোর্ট ও এ সংক্রান্ত সব ফাইল তলব করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ নিয়ে গঠিত নতুন ও পুরনো সব তদন্ত কমিটির সদস্যদের নাম চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সিভিল এভিয়েশন থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টও তলব করেছে মন্ত্রণালয়।

এই ঘটনা তদন্তে এর আগে বিমান ও সিভিল এভিয়েশন থেকে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিমানের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে জমা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত সিভিল এভিয়েশনের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়নি। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বিমানের ফুয়েল সিস্টেমে ত্রুটির কারণে ইঞ্জিনে তেলের সঙ্গে সুপার এবজরমেন্ট পলিমার (এসএপি) নামে এক ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ঢুকে যাওয়ার কারণে ইঞ্জিনটি পুড়ে যায়। ইঞ্জিনে থাকা ফুয়েল ফিল্টারটি নষ্ট থাকায় ও প্রকৌশল বিভাগের অবহেলার কারণে ওই ক্ষতিকর ‘এসএপি’ ইঞ্জিনে প্রবেশ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য বিমানের পক্ষ থেকে কর্পোরেট অ্যান্ড সেফটি বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি বিমান দেশের বাইরে লন্ডনসহ যে ১০ স্টেশন থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করেছিল সেসব দেশে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে বিমানের কমপক্ষে আরও ১ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, অবহেলার কারণে যদি ইঞ্জিনের ফুয়েল ফিল্টার পরিবর্তন না করায় এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। নতুন আনা এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন এভাবে পুড়িয়ে ফেলার তদন্ত যেনতেনভাবে কেউ করে পার পাবে না। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে এই ঘটনার সব ফাইল বিমানের কাছে তলব করা হয়েছে। ফাইলগুলো পাওয়ার পর সেগুলো স্টাডি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘তদন্তের নামে বিদেশ ভ্রমণের ফাইলে অনুমোদন দেয়া হবে না। কারণ ঘরে বসেই এসব তথ্য ই-মেইলের মাধ্যমে সংগ্রহ করা সম্ভব। এজন্য বিদেশ ভ্রমণ করে সরকারি টাকার শ্রাদ্ধ করার কোনো অর্থ নেই।’

উল্লেখ্য, ২০ জানুয়ারি ‘প্রকৌশল বিভাগের অবহেলা বিমানের ইঞ্জিন পুড়ে ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা’- শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, প্রকৌশল বিভাগের অবহেলায় বিমানের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এয়ারক্রাফটের একটি ইঞ্জিন পুড়ে গেছে। এতে বিমানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে একশ’ কোটি টাকার বেশি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইঞ্জিনের ফুয়েল ফিল্টার পরিবর্তন না করায় নতুন কেনা উড়োজাহাজটি এ ক্ষতির মুখে পড়ে। রক্ষণাবেক্ষণে প্রকৌশলীদের গাফিলতির কারণ দেখিয়ে ক্ষয়ক্ষতির দাবিও নাকচ করে দিয়েছে বীমা কোম্পানি। ৭ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী ফ্লাইট আকাশে ৩১ মিনিট চক্কর দেয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ বিমান গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, প্রতিটি ইঞ্জিনের একটি করে ফুয়েল ও অয়েল ফিল্টার থাকে। একটি ফুয়েল ফিল্টারের দাম ২০ হাজার টাকা। তেলের সঙ্গে যাতে পানি বা অন্য কোনো ময়লাজাতীয় পদার্থ কিংবা তেলের বাই-প্রডাক্ট ইঞ্জিনে প্রবেশ করতে না পারে সে কারণে ফিল্টারগুলো ব্যবহার করা হয়। বোয়িং চেকলিস্ট অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পরপর এই ফিল্টার পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। দীর্ঘদিন পরিবর্তন না করার ফলে ফিল্টারটি অকেজো হয়ে পড়ে। এতে তেলের সঙ্গে সুপার এবজরমেন্ট পলিমার (এসএপি) জাতীয় পদার্থ ইঞ্জিনে প্রবেশ করে, যা তেলের সঙ্গে বিকিরণ ঘটিয়ে আগুন তৈরি করে। এতে পুরো ইঞ্জিনটি পুড়ে যায়। পাইলট টেকঅফের জন্য প্লেন চালানো শুরু করলে ইঞ্জিনের ত্রুটি ধরা পড়ে। বিমানের এক পাইলট বলেন, এ অবস্থায় যদি এয়ারক্রাফটটি আকাশে উড়ত তাহলে মাঝ আকাশে ফ্লাইটটিতে আগুন ধরে ক্রাশ করার আশংকা ছিল।

রিপোর্টটি প্রকাশের পর বিমানের পক্ষ থেকে এ নিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়। ব্যাখ্যায় বলা হয়, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিনটি যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট ও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, বিমানের ইঞ্জিনে স্থাপিত ফুয়েল ফিল্টারের জন্য ইঞ্জিনটি বিকল হয়নি। মূলত জ্বালানি তেল (ফুয়েল) সরবরাহ গাড়ি-ডিসপেন্সার ইউনিট এবং তাতে সংযোজিত সুপার এবজরমেন্ট পলিমার (এসএপি) জাতীয় ফিল্টার হতে জ্বালানি তেলের মাধ্যমে এসএপি সংক্রামিত হয়ে ইঞ্জিনটি বিকল হয়েছে। ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী সংস্থা জিই, ইঞ্জিন মেরামতকারী সংস্থা জার্মানির এমটিইউ, বীমা কোম্পানি, বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিমানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে একাধিকবার পরীক্ষার মাধ্যমে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই রিপোর্টে ইঞ্জিন পুড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উড়োজাহাজের ফুয়েল ফিল্টারের কথা একবারও বলা হয়নি। উড়োজাহাজ মেরামতকারী সংস্থা বোয়িংয়ের মেইনটেন্যান্স প্রোগ্রাম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পরপর উড়োজাহাজের ফুয়েল ফিল্টারসহ সব ধরনের ফিল্টার পরিবর্তন করা হয়েছে এবং তা চলমান রয়েছে বলে বিমানের ব্যাখ্যায় বলা হয়।
কিন্তু তদন্তকারী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, বিমানের এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়। মূলত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতির হাত থেকে অভিযুক্তদের বাঁচাতে এই ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছে বিমান। হাতে আসা জার্মানির বিমান ওভারহোলিং কোম্পানি এমটিইউর একটি তদন্ত রিপোর্টেও দেখা গেছে কোথাও জ্বালানি তেল সরবরাহকারী গাড়ির ফুয়েল ফিল্টার থেকে এসএপি সংক্রামিত হয়ে বিমানের ইঞ্জিন পুড়ে গেছে এমন কোনো কথা লেখা নেই। ওই তদন্ত রিপোর্টের সমাপনী ও সুপারিশ বিভাগে লেখা আছে- ‘ফুয়েল সাপ্লাই চেইনে’ ত্রুটি থাকায় এয়ারক্রাফট ফুয়েল সিস্টেমে সুপার এবজরমেন্ট পলিমার (এসএপি) সংক্রামিত হয়ে ইঞ্জিনটি পুড়ে যায়। ওই রিপোর্টের কোথাও জ্বালানি তেলের গাড়িতে সংযোজিত ফুয়েল ফিল্টারে ত্রুটির কারণে ‘এসএপি’ সংক্রামিত হয়ে বিমানের ইঞ্জিন বিকল হওয়ার কথা উল্লেখ নেই। তবে ‘ফুয়েল সাপ্লাই চেইন’ সম্পর্কে রিপোর্টে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানির কাছ থেকে ওই ইঞ্জিনটি ক্রয় করা হয়েছিল। শিগগির আরও ৮টি ইঞ্জিন ক্রয় প্রক্রিয়াধীন আছে ওই কোম্পানির কাছ থেকে। জার্মানির ওভারহোলিং কোম্পানি এমটিইউ বিমানের ওভারহোলিং পার্টনার। বিমানের সঙ্গে তাদের বছরে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে। কাজেই এই দুটি কোম্পানির কাছ থেকে যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে তা শতভাগ বিশ্বাস করাও ঠিক হবে না। এর সত্যতা নিশ্চিতভাবে জানতে হলে নিরপেক্ষ সংস্থার কাছে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, ইঞ্জিনটি যখন যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে নেয়া হয় তখন রহস্যজনক কারণে বিমানের তদন্ত কমিটির কোনো সদস্যকে নেয়া হয়নি। প্রকৌশল শাখা থেকে যারা গেছেন তারা কেউ তদন্ত কমিটিতে ছিলেন না।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিভিল এভিয়েশন গঠিত তদন্ত কমিটির একজন সদস্য জানান, তিনি জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ সবগুলো তদন্ত স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিমান যেসব দেশ থেকে তেল সংগ্রহ করেছে সেসব দেশেও জ্বালানি তেলের সিস্টেম পরীক্ষা করতে গিয়েছিলেন। তার মতে বিমান এমন কিছু দেশ থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে সেসব দেশের জ্বালানি তেলের সিস্টেমে ভয়াবহ ত্রুটি রয়েছে। তার ধারণা ওইসব স্টেশন থেকে নেয়া তেলের মাধ্যমেও এই ‘এসএপি’ বিমানের ইঞ্জিনে প্রবেশ করতে পারে। তিনি বলেন, বিমানের প্রকৌশল বিভাগের একটি সিন্ডিকেট আছে যাদের সঙ্গে ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি, ওভারহোলিং কোম্পানি ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এরা প্রতি মাসে এসব কোম্পানির কাছ থেকে বড় ধরনের মাসোয়ারা পেয়ে থাকেন। দেশের বাইরে এসব মাসোয়ারার টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে। এ কারণে নানাভাবে এই চক্রটি কখনও ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি কখনও ওভারহোলিং কোম্পানি আবার কখনও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশ করে থাকে। চক্র এমনভাবে কাজ করে যাতে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে টাকা আদায় করা না যায়। জ্বালানি তেল ক্রয় নিয়েও একটি চক্র প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশী বিভিন্ন জ্বালানি সরবরাহ কোম্পানির কাছ থেকে।

যুগান্তর

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.