হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশেই সোনা চোরাচালান করছে দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট বা চক্র। ওই সব সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিমানবন্দরের কর্মী ছাড়াও জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, সোনার ব্যবসায়ীসহ অনেকেই। এই অবৈধ কাজ কয়েকটি ধাপে হয়ে থাকে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা মোবাইল ফোনে মেসেজের মাধ্যমে তথ্য দেয় বিমানের কর্মীদের। বহনকারীর সঙ্গেও তাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকে না। হোতারা নেপথ্যে থেকে কাজ করায় তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। পাচার হয়ে আসা সোনার সবচেয়ে বড় দুটি চালান উদ্ধার করার পর ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। এসংক্রান্ত দুটি মামলার তদন্ত শেষে সম্প্রতি আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তাতে সোনা পাচারের ওই দুটি ঘটনায় অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীও অভিযুক্ত হয়েছেন।
অবৈধ পথে আসা সোনার সবচেয়ে বড় চালান (১২৪ কেজি) ধরা পড়ার মামলায় গত ২ মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে ডিবি। এতে বিমানের সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর আগে ১৯ জানুয়ারি দাখিল করা হয় ১০৬ কেজি সোনার চালান আটকসংক্রান্ত মামলার অভিযোগপত্র। এতে অভিযুক্ত করা হয় বিমানের ১০ কর্মীসহ ২৫ জনকে। আসামিদের মধ্যে বিমানের দুজন উভয় মামলায়ই অভিযোগপত্রভুক্ত। ওই দুজন হলেন বাংলাদেশ বিমানের সিনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার শাহজাহান সিরাজ এবং এয়ারক্রাফট মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূইয়া। ২০১৩ সালে ১২৪ কেজি সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকলেও প্রথমে তাঁরা ধরা পড়েননি। পরে ডিবির তদন্তে বেরিয়ে আসে তাঁদের নাম।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এয়ারক্রাফট মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূইয়ার মোবাইল ফোনে আসা মেসেজের সূত্র ধরে ১০৬ কেজি সোনা উদ্ধার করার পাশাপাশি যোগাযোগ ও সিন্ডিকেটের ব্যাপারে তথ্য পান তদন্তকারীরা। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোনার চালান এলে বিমানবন্দর থেকে তা বের করে দিতে সিন্ডিকেটের সহযোগীদের মোবাইল ফোনে মেসেজ দেওয়া হয়।
ডিবির উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, দেশের ইতিহাসে বড় দুটি সোনার চালান উদ্ধারের ঘটনায় দীর্ঘ তদন্ত শেষে জড়িতদের শনাক্ত করা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ জানুয়ারি ১০৬ কেজি সোনা চোরাচালান মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন ডিবির সিনিয়র সহকারী কমিশনার এ কে এম মাহবুবুর রহমান। এতে বিমানের ১০ জনসহ ২৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন বাংলাদেশ বিমানের সিনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার শাহজাহান সিরাজ, জুনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার এস এম আ. হালিম, এয়ারক্রাফট মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূইয়া, এসি মেকানিক নিয়াজ মাহমুদ, এয়ারক্রাফট মেকানিক মিলন খন্দকার, সহকারী মেকানিক ইমরান, এসি মেকানিক শেখ হারুন আর রশিদ, এসি মেকানিক মতিন মিয়া, জুনিয়র টেকনিশিয়ান সিরাজুল ইসলাম ও জুনিয়র টেকনিশিয়ান এস এম হালিম। অভিযুক্ত সবাইকেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
১২৪ কেজি সোনা চোরাচালান মামলার অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি করা হয়েছে নেপালের নাগরিক গৌরাঙ্গ রোসানকে। অন্য আসামিরা হলেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিলন শিকদার, বাংলাদেশ বিমানের জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার এস এম কামরুল হাসান, বিমানের সুইপিং সুপারভাইজার আবু জাফর, বিমানের এয়ারক্রাফট মেকানিক মাসুদুর রহমান, এয়ারক্রাফট মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূইয়া, এয়ারক্রাফট মেকানিক মুজিবর রহমান, শাহজাহান সিরাজ ওরফে বাবুল, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আবদুল বারেক তরফদার, পশ্চিম মাদারটেক এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী সালেহ আহম্মদ খান, বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সালেহ উদ্দিন, নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার ব্যবসায়ী মানিক মিয়া, ব্যবসায়ী সুব্রত কুমার দাস ওরফে লিটন, ব্যবসায়ী এস এম নুরুল ইসলাম, সালেহ আহম্মেদ, রংপুরের মিঠাপুকুরের রায়হান আলী, নেত্রকোনার ইসলামপুরের ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম এবং চোরাই সোনার বহুল আলোচিত বাহক জসিম উদ্দিন। এঁদের মধ্যে পাঁচজন পলাতক আছেন। তাঁরা হলেন গৌরাঙ্গ, এস এম নুরুল ইসলাম, রায়হান আলী, সিরাজুল ইসলাম ও জসিম উদ্দিন। সালেহ আহম্মেদ উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।
যেভাবে ধরা পড়ে ১০৬ কেজি সোনা : ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল দুবাই থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসা একটি ফ্লাইটের সাতটি টয়লেট থেকে ১০৬ কেজি সোনা উদ্ধার করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। পরদিন এয়ারক্রাফট মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদিন ভূইয়াকে থানায় সোপর্দ করে এজাহার দাখিল করা হয়। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল দুবাই থেকে আসা বিজি ৩৫২ নম্বর ফ্লাইটে তল্লাশিকালে এয়ারক্রাফট মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন শুল্ক গোয়েন্দাদের কাছে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। পরে তাঁর মোবাইল ফোন জব্দ করে যাচাই করতে গিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা দেখতে পান, ওই ফোনে তিনটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে মেসেজ আসে। মাসুদ নামের এক ব্যক্তি ০১৭৮২৪২১৪০৮ নম্বর থেকে মেসেজে বলেন, ২২ নম্বর সিটের দিকে নজর রাখতে। পরে ওই সিটের কাছে টয়লেটের কমোডের পেছনের চেম্বারে এক প্যাকেট সোনার বার পাওয়া যায়। এভাবে সাতটি টয়লেট থেকে ৯০৪টি সোনার বার (ওজন ১০৫ দশমিক ৪০ কেজি) উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মফিজ উল্লাহ। পরে বিমানবন্দর থানার ওসি নিজেই মামলার তদন্ত করেন। আসামি আনিস উদ্দিন ভূইয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ২০১৪ সালের ২৭ মে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবির উত্তর বিভাগকে। প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন সিনিয়র এসি মিনহাজুল ইসলাম। এরই মধ্যে নিয়াজ মাহমুদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুই আসামির মোবাইল ফোনে যোগাযোগের সূত্র ধরে আরো ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এই ২৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করার পর ১০৫ কেজি সোনা চোরাচালানের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পান তদন্তকারীরা। এই আসামিদের মধ্যে পারভেজ, রিপন, লিটন, শাহজাহান সিরাজ, মিলন, মজিবুর মামুন, কামরুল হাসান, মুকুল, নিয়াজ মাহমুদ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরবর্তী দুই বছরে সিনিয়র এসি মোস্তাফিজুর রহমান, শাহিনুর রহমান ও নাজমুল হক তদন্তের দায়িত্ব পান।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ বিমানের এয়ারক্রাফট মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূইয়ার নকিয়া ৩০১ মডেলের মোবাইল ফোনটি ছিল মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এই ফোন জব্দ করেই সোনা চোরাচালানের যোগাযোগের সূত্র পান তদন্তকারীরা।
এদিকে বিমানের এসি মেকানিক নিয়াজ মাহমুদ তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, আনিস তাঁকে মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে বিমানের টয়লেটে সোনা রাখা আছে বলে জানান। চালানটি হাতবদল হলে তিনি দুই-তিন হাজার টাকা পেতেন বলে দাবি করেন।
১২৪ কেজি সোনা চোরাচালান : ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজ থেকে ১২৪ কেজি সোনা পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর মামলা করা হয়। গত ২ মার্চ দাখিল করা অভিযোগপত্রে নেপালের নাগরিক গৌরাঙ্গ রোসানকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। রাজধানী কাঠমাণ্ডুর গাওয়ারপুরের বাসিন্দা তিনি। বিমানের কিছু অসাধু কর্মচারী এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর যোগসাজশে ১২৪ কেজি সোনার চালানটি দুবাই থেকে অবৈধভাবে আনেন গৌরাঙ্গ। চালানটির গন্তব্য ছিল ভারত।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ মামলার তদন্তে জেমস প্রিন্স নামের এক ভারতীয় ব্যক্তির নাম এলেও পূর্ণ ঠিকানা না পাওয়ায় তাকে চার্জশিটভুক্ত করা যায়নি। এ ছাড়া মাকসুদ ও ওসমান গনি নামে বিমানের দুই কর্মচারীর নাম প্রাথমিকভাবে জানা গেলেও নিবিড় তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য মেলেনি।
সূত্র মতে, গুলশানের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী সালেহ আহম্মেদ দীর্ঘদিন ধরে চোরাই সোনার ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১২৪ কেজি সোনা চোরাচালান মামলা ছাড়াও এ ধরনের আরো দুটি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি সালেহ। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, সালেহর সঙ্গে আলোচিত সোনা চোরাকারবারি মোহাম্মদ আলী ও রিয়াজ উদ্দিনসহ অনেকের ঘনিষ্ঠতা ছিল।
বিমানের দুজনের মাধ্যমেই রহস্য উন্মোচিত : ১০৬ কেজি সোনা চোরাচালান মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, রাজধানীর দক্ষিণখানের চালাবন এলাকার জাকির মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া আনিস উদ্দিন মিয়া ২৩-২৪ বছর বিমানের এয়ারক্রাফট মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১০-১২ বছর আগে নিরাপত্তার কাজ করার সময় তাঁর সঙ্গে লাগেজ ব্যবসায়ী পিন্টুর পরিচয় হয়। ১০৬ কেজি সোনার চালানটি আনতে পিন্টুই আনিস উদ্দিনকে প্রস্তাব দেন। এরপর লিটন ও পাভেলের (তদন্ত পরে জানা যায় পারভেজ) যোগাযোগ করিয়ে দেন। আনিস তাঁর জবানবন্দিতে জানান, বিমানের কর্মচারী মাসুদ, সিরাজ ও হারুন সোনা চোরাচালানের ব্যাপারে জানতেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ বিমানের সিনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার শাহজাহান সিরাজ সোনার চালান হস্তান্তরের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৩ সালে ১২৪ কেজি সোনা পাচারে জড়িত থাকলেও প্রথমে তিনি ধরা পড়েননি। এরপর ১০৬ কেজি সোনার চালান আনার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। আনিসসহ অন্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর নাম উঠে আসে। এরপর তদন্তে বিমানের অন্য কর্মকর্তাদের ব্যাপারেও তথ্য পায় পুলিশ।