যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ পরিস্থিতি

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ পরিস্থিতি।

উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য এখন, এই মুহূর্তে, আরও উত্তপ্ত হয়েছে। গালফ অব ওমানে দুই তেলের জাহাজ মাইনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং হরমুজ প্রণালিতে ইরানের আকাশসীমায় ইরান কর্তৃক একটি মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার পর সেখানে এখন ফের এক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা আগে দেখা যায়নি।
গালফ অব ওমানে জাহাজের ওপর আক্রমণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে দায়ী করা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত এর কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। অন্যদিকে, মার্কিন ড্রোনটি অবশ্যই ইরানের আকাশসীমার মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়েছে।
অন্যথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক মিনিট অপেক্ষা না করেই ইরানের ওপর আক্রমণ করত। কিন্তু তাদের পক্ষে সেটা সহজ ও সম্ভব হচ্ছে না অনেক কারণে। তার মধ্যে একটা হল ইরান ইরাক নয়।
ইরানের সামরিক বাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী, যদিও তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরাকে যুদ্ধ এবং শাসন পরিবর্তন যত সহজে হয়েছিল, ইরানে যে সেটা সম্ভব নয়, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভালোভাবেই জানা আছে। তাছাড়া ইরানের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে যতই বিক্ষোভ কোনো কোনো বিষয়ে থাকুক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানের জনগণ সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ এবং সর্বপ্রকার বেসামরিক প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে তাদের পারমাণবিক চুক্তি একতরফাভাবে হঠাৎ করে বাতিল এবং সেই সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে নানা অবরোধ সৃষ্টির কারণে হঠাৎ করেই মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির অবনতি হয়ে সেখানে এক অতি বিপজ্জনক অবস্থা দেখা দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররা ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে ষড়যন্ত্র করছে তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে একমত হলেও হঠাৎ করে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করার তারা বিরোধী। কারণ এর দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা ইরানের তেলের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। তাছাড়া হঠাৎ করে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে অন্য সমস্যাও আছে।
গালফ অব ওমানে কারা তেলের জাহাজে আক্রমণ করছে এ নিয়ে সারা বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দ্বারা কোনো সঠিক তথ্য না পাওয়ার একটা কারণ হতে পারে এটি ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ ও তাদের সামরিক বাহিনীর কাজ। এ ধরনের কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে মোসাদকে দিয়েই করিয়ে নিচ্ছে।
যথেষ্ট সন্দেহের কারণ আছে যে, ভারতের নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক শক্তির নতুন উত্থান ঘটিয়ে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে সিআইএ ও মোসাদ যৌথভাবেই এক্ষেত্রে চক্রান্ত করেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কাশ্মীরের ৪০ জন সামরিক ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড ভারতে হিন্দুত্ববাদের প্রচারণাকে তুঙ্গে তুলতে বিজেপিকে সহায়তা করেছিল।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীরা যে কত চাতুর্যের সঙ্গে এবং বিপজ্জনকভাবে কাজ করে, তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্তের অভাব নেই। যাই হোক, কার্যত দেখা যাচ্ছে যে, নরেন্দ্র মোদি যেভাবে কাশ্মীরের সামরিক বাহিনীর লোকদের হত্যাকে ব্যবহার করেছিলেন, সেভাবেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং বোল্টনের মতো তার যুদ্ধবাজ নিরাপত্তা উপদেষ্টারা এখন উঠেপড়ে লেগেছেন।
তার ওপর ঘটেছে হরমুজ প্রণালিতে ইরানের আকাশসীমার মধ্যে মার্কিন ড্রোন ধ্বংসের ঘটনা। পরিকল্পিতভাবেই যে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি এবং ইরান আক্রমণের জন্য এসব চক্রান্ত করা হচ্ছে, এ চিন্তার মধ্যে যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবিধান আছে যাকে তারা পবিত্র মনে করে। কিন্তু এই ‘পবিত্রতা’ সত্ত্বেও সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ইচ্ছাকৃতভাবে এ সংবিধান নানা ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করছেন। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হল অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।
সংবিধান অনুযায়ী অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কংগ্রেসের অনুমোদনের কোনো পরোয়া না করে ইরাক আক্রমণ ও দখল করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট এবং কংগ্রেসও সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বুশের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ বা অন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
এর থেকেই বোঝা যায় এই সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক কাজের প্রতি কংগ্রেস ও সুপ্রিমকোর্টের সমর্থন ছিল। এবার কিন্তু অবস্থা দাঁড়িয়েছে অন্যরকম। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টারা তার ওপর যুদ্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করেননি। মার্কিন সিনেট থেকে বলা হয়েছে, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হলে প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে হবে।
এই নির্দেশ ট্রাম্প কতখানি মেনে চলবেন সেটা স্বতন্ত্র কথা; কিন্তু তবুও কংগ্রেসের এই বিরোধিতার গুরুত্ব আছে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যি সত্যি ইরানে আক্রমণ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তাহলে তার পরিণতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ক্ষমতার সীমানা কমে আসবে।
মধ্যপ্রাচ্যে তার মিত্রদেরও নড়েচড়ে বসতে হবে, কারণ এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টারা এবং ইসরাইল তাকে যুদ্ধের জন্য যতই প্ররোচিত করুক, যুদ্ধ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে ট্রাম্পকে অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হচ্ছে।
ইরাকের সঙ্গে ইরানের একটা বড় পার্থক্য হল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ইরানের জনগণের আদর্শিক অবস্থান, সে আদর্শের চরিত্র যাই হোক। তারা বর্তমান ইরান সরকারের কোনো কোনো নীতির বিরোধিতা করলেও দেশের শাসনব্যবস্থায় ইসলামী নীতি বহাল রাখার ক্ষেত্রে তারা শক্তিশালীভাবে ঐক্যবদ্ধ। এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাকে ছিল না।
এটা সাম্রাজ্যবাদীদের, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় বিবেচনার বিষয়। কারণ ইরান আক্রমণ করে দখলে রাখা সহজ হবে না। ইরানের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ শক্তি বেসরকারি ক্ষেত্রে ইরাকের থেকে অনেক বেশি।
সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, হরমুজ প্রণালিতে ইরান কর্তৃক মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান আক্রমণ করার সামরিক নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি সেই নির্দেশ প্রত্যাহার করেন এখনকার মতো। এই জন্য তারা ২০ জুন হোয়াইট হাউসে সর্বদলীয় এক সভা করেছেন, যাতে বিরোধী দলের প্রতিনিধি এবং বোল্টনের মতো যুদ্ধবাজরাও ছিলেন।
যুদ্ধবাজদের নিরন্তর তাগিদ ও একটানা যুদ্ধ প্ররোচনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আপাতত ইরান আক্রমণ করার বিষয় থেকে সরে আসতে হয়েছে। চিন্তার ব্যাপার যে, যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, I find it hard to believe it was intentional’. Trump said, ‘I think it could have been somebody who was loose and stupid’ (Daily Star, 23.6.2019).
এ সবের দ্বারা ট্রাম্প এখানে স্পষ্টই বোঝাতে চাইছেন যে, ড্রোন ভূপাতিত করার বিষয়টি ইরান সরকারের ইচ্ছাকৃত না হতেও পারে। এটা হতে পারে কোনো নির্বোধ ব্যক্তির কাণ্ড! এটা যে যুদ্ধ ঘোষণা থেকে পিছিয়ে আসার একটা অসার যুক্তি এতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু ট্রাম্প এসব কথা বলে তার যুদ্ধবাজ নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের চাপ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একথা সবাই জানে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে একজন চরম যুদ্ধবাজ এবং সম্ভব হলে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সদাই প্রস্তুত। কাজেই তার এভাবে পিছিয়ে আসাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
ট্রাম্পের এই পিছিয়ে আসার কারণ অনেক। শুধু মার্কিন সিনেটের প্রস্তাবই নয়, তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের প্রতিনিয়ত এক্ষেত্রে তাকে বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। আসলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যদি ইরানের মতো কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তাহলে মার্কিন অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং সাধারণভাবে দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্য এখনও পর্যন্ত আছে তা বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এসব বিবেচনা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো একজন ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে এখন যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে করতে হচ্ছে। কাজেই যুদ্ধের পরিবর্তে এখন তারা ইরানের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপের মধ্যেই নিজেদের শত্রুতা বজায় রেখে চলার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদ এমন জিনিস যা দুনিয়ার অনেক অসুবিধাকে উপেক্ষা করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা নিরন্তর করে থাকে। কাজেই শেষ পর্যন্ত তারা ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। সব কিছুই নির্ভর করছে দুইপক্ষ পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিভাবে অগ্রসর হয় তার ওপর।
ট্রাম্প একতরফাভাবে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করার পর তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা, চীন ও রাশিয়া তা মান্য করে চলার ঘোষণা দিলেও তারা এক্ষেত্রে কার্যত কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এজন্য ইরান এখন তাদেরকে নোটিশ দিয়েছে যে, ১০ দিনের মধ্যে তারা এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্তে উপনীত না হলে ইরানও চুক্তি অমান্য করে তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কর্মসূচি শুরু করবে।
এটা যদি ঘটে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররা ইরানের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেবে এটা দেখার বিষয়। এর ওপর মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি অনেকখানিই নির্ভর করবে।
২৩.০৬.২০১৯
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.