ভেন্টিলেটর নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যা হয়েছে

নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারিতে চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতাই সবচেয়ে বেশি চোখে লাগছে। নিরাপত্তার জন্য মাস্ক থেকে শুরু করে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা ভেন্টিলেটরের এক ভয়াবহ স্বল্পতার অভিজ্ঞতা নিচ্ছে বিশ্ব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোও এই সংকটকালে ভেন্টিলেটরের মতো জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে ভেন্টিলেটরের স্বল্পতা ঠিক কোন মাত্রার, তার হদিস নেওয়া যাক। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে জোগানের তুলনায় ভেন্টিলেটরের চাহিদা দশগুণ। অর্থাৎ ভেন্টিলেটর প্রয়োজন এমন দশজন রোগীর বিপরীতে রয়েছে মাত্র একটি করে ভেন্টিলেটর। যুক্তরাষ্ট্রেরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে অন্য দেশগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

ইতালি মৃতের সংখ্যার বিচারে সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হলো শুধু জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতায়। আরও ভালো করে বললে, শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর না থাকায় এমন বিপদে পড়তে হয়েছে ইতালিকে। ভেন্টিলেটর স্বল্পতার এ সংকট এখন গোটা বিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা সরাসরিই বলছেন যে, এমন পরিস্থিতির মুখে এখন দাঁড়িয়ে বিশ্ব, যেখানে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো একাধিক রোগীর মধ্যে কাকে বাঁচানো হবে, তার সিদ্ধান্ত চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টদেরই নিতে হবে।

কিন্তু এই সংকট কেন তৈরি হলো? এর উত্তর খুঁজতে যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই তাকানো যাক। দেশটির অন্যতম প্রধান সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, ১৩ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের এক দল জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা মার্কিন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি চিহ্নিত করেন, তা মোকাবিলায় একটি পরিকল্পনার কথাও জানান। ঝুঁকিটি ছিল ‘ভেন্টিলেটরের স্বল্পতা’। ওই কর্মকর্তাদের ভাষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রে সে সময় যত সংখ্যক ভেন্টিলেটর ছিল, তা বড় ধরনের সংকট মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। এ কারণে তাঁরা সহজে বহন করা যায় এবং কম খরচে ভেন্টিলেটর উৎপাদনের একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। তাঁদের সেই প্রস্তাব পাস হয়েছিল, হয়েছিল অর্থ বরাদ্দও। ‘প্রজেক্ট অরা’ নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ। লক্ষ্য ভেন্টিলেটরের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা এবং বাজারমূল্য ৩ হাজার ডলারের নিচে নামিয়ে আনা।

ফেডারেল চুক্তি সইয়ের পর সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল। নতুন এই ভেন্টিলেটর তৈরির দায়িত্ব পায় ‘নিউপোর্ট’ নামের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের তৈরি ভেন্টিলেটর উৎপাদনের জন্য ছাড়পত্রও পায়। কিন্তু তারপরই ওই ছোট প্রতিষ্ঠানকে কিনে নেয় কোভিডিয়েন নামের বড় একটি প্রতিষ্ঠান। তারা প্রকল্পটির মুনাফা তৈরির ক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান ছিল। বহু চিকিৎসা সরঞ্জামের উৎপাদক ওই প্রতিষ্ঠান জানায়, কম মূল্যের ভেন্টিলেটরের উৎপাদন এই মুহূর্তে ‘টপ প্রায়োরিটি’ নয়। ২০১২ সালে নিউপোর্টের কর্মকর্তারা মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের তৈরি ভেন্টিলেটর বাজারে বিক্রির অনুমোদন চায়। কিন্তু বাদ সাধে কোভিডিয়েন। তারা জানায়, বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে তারা ডিভাইসটির দাম আরও বেশি রাখতে চায়। একই সঙ্গে তারা সরকারের কাছ থেকে আরও অর্থ বরাদ্দ চায়। ফেডারেল সরকার শেষ পর্যন্ত ১৪ লাখ ডলার বরাদ্দ দিলেও কাজ হয়নি। ওই প্রকল্পের আওতায় আজ পর্যন্ত কোনো ভেন্টিলেটরও উৎপাদন হয়নি। পরে ২০১৪ সালে ফেডারেল সরকার অন্য একটি কোম্পানির সঙ্গে একই বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়, যাদের তৈরি ভেন্টিলেটর গত বছর অনুমোদন পেলেও তারা এখনো কোনো ভেন্টিলেটর বাজারে সরবরাহ করতে পারেনি।

বৈশ্বিক ভেন্টিলেটর বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করত কোভিডিয়েন। নিউপোর্টের তৈরি কম দামের ভেন্টিলেটর বাজারে এলে, তাদের বাজার হুমকিতে পড়তে পারত। এ কারণেই তারা নিউপোর্টকে ১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিউপোর্টকে কিনেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, প্রচলিত ভেন্টিলেটরের বাজারকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে তারা জীবন রক্ষাকারী একটি চিকিৎসা সরঞ্জামের উৎপাদন স্থগিত করে দেয়। যেকোনো মূল্যে স্বল্পমূল্যের ভেন্টিলেটরের উৎপাদন ঠেকানোই যেন ছিল তাদের লক্ষ্য ছিল। এমনকি অন্য কেউ যেন এতে না ঢুকতে পারে, সে জন্য তারা ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটি ভেন্টিলেটর উৎপাদন না করেও মার্কিন ফেডারেল সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে থেকে গিয়েছিল।

করপোরেট পুঁজির অতি মুনাফালোভী চরিত্র এমন বহু উদ্যোগকে গোড়াতেই শেষ করে দিচ্ছে। এই লোভ যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশকেই অন্তত ছয় বছর পিছিয়ে দিয়েছে, যা না হলে এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হয়তো এতটা বিপাকে পড়তে হতো না। মুনাফার প্রতি এই লোভ এমন এক ভয়াবহ ব্যর্থতার জন্ম দিয়েছে, যার ভার এখন সবাইকে বহন করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় প্রশাসন ভেন্টিলেটরের জোগান নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। ভবিষ্যৎ জোগানের কথা ভেবে নির্ঘুম হতে হচ্ছে সৎ প্রশাসক মাত্রই। জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী হেসে শেফারের মৃত্যু (যাকে আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে) কিংবা নেদারল্যান্ডসের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ক্লান্তিজনিত পদত্যাগ এ সবই অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা ও পুঁজির এক অবধারিত ফল হয়ে সামনে চলে এসেছে।

এখন চিকিৎসকদের আক্ষরিক অর্থেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে, তাঁরা কার শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা দেবেন, কাকে দেবেন না। এটি চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি করছে, যা হয়তো দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পরও দীর্ঘ দিন তাঁদের বহন করতে হবে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে জানানো হয়, মার্কিন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা—যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অন্তত সাড়ে ৯ লাখ ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন পড়তে পারে। অথচ তাদের হাতে রয়েছে মাত্র ২ লাখ ভেন্টিলেটর।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বা চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনের বিষয়টি বেসরকারি খাতে একেবারে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছেড়ে দেওয়ার বড় খেসারত এখন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও মুক্তবাজারের অনুরাগীরা এটা ভেবে দেখেনি যে, পুঁজিপতিরা সেখানেই বিনিয়োগ করেন, যেখান থেকে মুনাফা বেশি আসে। এমনকি তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম কাঙ্ক্ষিত মানে রাখতে কৃত্রিম সংকট তৈরি থেকে শুরু করে নানা খেলাও খেলতে পারে। জনগণের জীবনের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া রাষ্ট্রের চেয়ে একটি কোম্পানির লক্ষ্য সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষের ভোটে বা সমর্থনে গঠিত সরকারের দায়—জনগণের সুরক্ষা। আর কোম্পানির লক্ষ্য বা দায় য-ই বলা হোক একটিই—আরও বেশি মুনাফা।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) সাবেক পরিচালক ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ড. থমাস আর ফ্রিডেন বলেন, ‘আমরা সংকটটি এখন বুঝতে পারছি। হয়তো এটি আমরা ঠিকঠাক মোকাবিলা করতে পারব। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী (ভেন্টিলেটরের) সরবরাহ পাব না।’

থমাস ফ্রিডেনের এই বক্তব্য অবশ্যই আশা জাগানিয়া। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সার্স, মার্স, বার্ড ফ্লু ও সোয়াইন ফ্লু একইভাবে বৈশ্বিক মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরির পরই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সহজে বহন করা যায় এবং স্বল্পমূল্যের ভেন্টিলেটর উৎপাদনের এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। একই ধরনের নানা প্রকল্প ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও নেওয়া হয়। সে প্রকল্পগুলোর ভাগ্যে কী হয়েছে, তার অনুসন্ধান না করে শুধু এখনকার পরিণতির দিকে তাকালেই হতাশ হতে হয়। কারণ, বিগত ওই মহামারিগুলোও বৈশ্বিক পুঁজি কাঠামো ও সরকারগুলোকে সচেতন করার মতো যথেষ্ট ছিল না। এরই ফল হচ্ছে আজকের চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতা।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.