গালওয়ান উপত্যকার রক্তপাতের পরে দুটি নতুন খবরে কান খাড়া করেছে ভারত। তিব্বত–নেপাল সীমান্ত সংলগ্ন ১০টি এলাকার ৩৩ হেক্টর কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নেপাল মানচিত্র বিরোধের পর বিহার দিল্লিতে নালিশ জানিয়েছে, নদী শাসন কাজে তারা নেপালীদের দ্বারা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। উল্টো নেপালি মিডিয়া বলছে, তারা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্যে বাধা পাচ্ছে।
সবমিলিয়ে দক্ষিণ এশিয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, করোনাকালে বাংলাদেশের আশেপাশে কৌশলগত সীমান্ত উত্তেজনা কমছে না। বরং চীন ও পাকিস্তানের মতোই অনেকটা কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে ভারত–নেপাল সম্পর্কও। এর ফলে মানবজাতির এক অস্তিত্বের সংকটে উপমহাদেশে মানচিত্র বিরোধে জড়িয়ে পড়ার রেশ মিলিয়ে যাচ্ছে না। বরং জমাট হচ্ছে।
বর্তমান বিতর্ক হচ্ছে কালাপানি, লিপুলেখ এবং লিম্পিয়া ধাউরা নিয়ে।
২৬ জুন বিহার থেকে নতুন উদ্বেগ পৌছালো দিল্লিতে। নেপাল-ভারত সীমান্তে নদীভাঙন এবং নদীর চরে ক্ষয়রোধের কাজ দু’দেশ ভালোভাবেই এগিয়ে নিচ্ছিল। এমনকি মানচিত্র সংকটের পরেও। এখন বলা হচ্ছে, কিছুদিন আগে বিহারের পূর্ব চম্পারন জেলায় এই কাজে কাঠমান্ডু বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিহার সরকার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা চেক পয়েন্ট থেকে নেপালের কাকরভিটার দূরত্ব মাত্র ৯০ কিমি। এখন নেপালি মিডিয়া বলল, পশ্চিমবঙ্গের কাকরভিটা চেক পয়েন্ট থেকে নেপালে পণ্যবাহী লরি ঢুকতে বাধা পাচ্ছে। অবশ্য নেপালি মিডিয়া রিপোর্ট নস্যাৎ করে উদ্বিগ্ন সাউথ ব্লক মুখপাত্র জানিয়েছেন, বিলকুল ঠিকঠাক চলছে। দু’দেশের স্থলবাণিজ্য করোনা-কালেও থেমে নেই।
ওদিকে চীনের নেপাল সীমান্ত সংলগ্ন তিব্বতকে লক্ষ্য রেখে রাস্তা এবং পরিকাঠামো নির্মাণ বাড়াতে নেপালের ১০টি এলাকার ৩৩ হেক্টর জমির দখল নিয়েছে চীন— কাঠমান্ডু থেকে এমন রিপোর্টও সাউথ ব্লকে এসেছে বলেও ভারতীয় মিডিয়া দাবি করছে।
এই নতুন তথ্য বিষয়ে এখনও চীন বা নেপাল কেউ মুখ খোলেনি। তবে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে সাউথ ব্লক। তারা দেখছে, ‘নেপাল চীনকে উপহার দিল নাকি চীন শুধু দরকার পড়েছে, বলে নিয়ে নিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সন্দেহ, ভারতীয় সীমান্তের উপর নজরদারি এবং ভারতকে ঘিরে ফেলার যে পরিকল্পনা বেজিংয়ের রয়েছে, এই পদক্ষেপ হতে পারে তারই অংশ।
অন্য দিকে ভারতের মিডিয়া বলছে, নেপালের বিরোধী রাজনৈতিক শিবির থেকে অভিযোগ উঠছে, গদি রক্ষায় চীনের কাছে দেশের স্বার্থ বিক্রি করে দিয়েছেন ক্ষমতাসীন কে পি ওলি সরকার। কিন্তু বিশ্লেষকরা জানেন নতুন মানচিত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত কেপে ওলি সরকার সংসদে সর্বসম্মতভাবে পাস করিয়ে নিয়েছেন।
ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত দলটির সাংসদরা সংসদে হাজির ছিলেন। তারা কেউ বিপক্ষে ভোট দেননি। গত ১৩ জুন নেপালি প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্টে ২৭৫টি ভোটের মধ্যে ২৫৮ ভোট পেয়ে পাস হয় নেপালের মানচিত্র পরিবর্তনের বিল।
উল্লেখ্য, ভারতীয় ভূখন্ড বলে দাবি করা কালাপানি আর লিপুলেখকে নেপাল তার নতুন মানচিত্রে দেখানোর পর থেকেই দুই প্রতিবেশীর কুটুম্বতা হিমশীতল হওয়া শুরু।
নেপালের অর্থমন্ত্রী ইউভরাজ খাটিওয়াদা এর আগে বলেছিলেন, নতুন এই মানচিত্র স্কুল-কলেজের বইপত্রে, সরকারি প্রতীকে এবং অফিস-আদালতের সব কাগজপত্রে এখন থেকেই ব্যবহার করা হবে। বিবিসি’র নেপালী সার্ভিস তথ্য দিয়েছিল, ভারতের সাম্প্রতিক তিনটি পদক্ষেপ নেপালকে ওই সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করে।
গত বছর ভারত নতুন একটি রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করেছিল। যেখানে এই বিতর্কিত ভূমি দু’টি তাদেরই ভূখন্ড হিসেবে দেখানো হয়। এরপর করোনাকালে গত ৮ মার্চ ভারতীয় রাজ্য উত্তরাখণ্ডের পিথাউরাগড়-লিপুলেখের মধ্যে একটি লিংক রোডের উদ্বোধন করেন ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।
যখন রাজনাথ সিং ওই সড়কের উদ্বোধন করেন, তখন নেপাল কাঠমান্ডুতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল। শুধু তাই নয়, সীমান্ত তারা একইসঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে, ইতিহাসে যা নজিরবিহীন।
এটা ছিল নেপালের তরফে বড় কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ। তারা তাদের আপত্তির বিষয়টি উল্লেখ করে একটি কূটনৈতিক নোটও দিয়েছিল। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতিতে বলেছে, তারা নিজেদের ভূখণ্ডেই সড়কটি নির্মাণ করছে।
এই ঘটনার কদিন বাদেই ওই অঞ্চলে গিয়ে ভারতের চীফ অব আর্মি স্টাফ মনোজ নারাভানে চীনকে আক্রমণ করেন। এখন মনে করা হয়, এসব ঘটনাও লাদাখে ভারত–চীনকে মুখোমুখি ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পাটভূমি তৈরিতে সহায়তা দেয়। ভারতীয় সেনা প্রধান মন্তব্য করেছিলেন যে, ওই লিংক রোডের ব্যাপারে নেপাল সরকারের আপত্তি এসেছে আসলে ‘অন্য কারো নির্দেশে’।
উল্লেখ্য, নেপাল ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত এলাকার বেশ কয়েকটি জায়গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বিরোধের কেন্দ্রে থাকা ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে কালাপানি, লিপুলেখ এবং সুস্তা অন্যতম। বহু বছর ধরে এসব ইস্যুতে আলোচনা করে যাচ্ছে নেপাল এবং ভারত। প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনায় দেশ দুটো সম্মত হয়েছে যে সীমান্তের এসব সমস্যা সচিবদের বৈঠকে সমাধান করা হবে । যদিও সে রকম কোন বৈঠক এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৮১৬ সালের ৪ মার্চ নেপাল ও ভারতের মধ্যকার সীমানা নির্ধারিত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নেপালের রাজার মধ্যে স্বাক্ষরিত সুগাউলি চুক্তির মাধ্যমে। এই দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার মুক্ত সীমান্ত রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সীমানাজুড়েই নদী।
নেপাল মনে করে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে তারা ভারতকে ছাড় দিয়েছিল। এখন তারা তার মাশুল দিচ্ছে। কারণ ভারত চীনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকে ভারত নেপালের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ডে সেনাচৌকি বসানো শুরু করে। তারা নেপালের কালাপানিতে সেনাশিবির তৈরি করে। এরপর আর সেনা প্রত্যাহার করেনি। বরং সেনাচৌকির সংখ্যা ক্রমেই বাড়িয়েছে। তবে ভারত বরাবরই এ দাবি অগ্রাহ্য করে আসছে।
স্থলবন্দী নেপালের ভারত নির্ভরশীলতা ঐতিহাসিক। সেখান থেকে তারা বেরিয়ে আসছে। ২০১৫ সালে নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির কেপি শর্মা ওলি। তিনি ভারত নির্ভরশীলতা হ্রাসের জিগির তুলেই ক্ষমতায় আসেন।
২০১৬ সালের এক চুক্তির পর নেপাল চীনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করছে। এতে তাদের ভারত–নির্ভরশীলতা অনেকাংশেই কমেছে। এ ছাড়া নেপালে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্প, ভারত আমেরিকার সঙ্গে সুর মিলিয়ে যার বিরোধীতা করছে, তার আওতায় নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে তারা।
নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, গদি সামলাতে চীনা ফ্যাক্টর দুরকমভাবে লভাংশ দিচ্ছে মোদী ও ওলিকে। জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন দুজনেই। কিন্তু চীনা পদক্ষেপ বা চীনপন্থী হওয়া একটা আশীর্বাদ দুজনের জন্য। ওলিতো বেশ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন।
২০১৯ সালের নভেম্বরে দ্বিখণ্ডিত জম্মু-কাশ্মীরের যে ম্যাপ ভারত প্রকাশ করে, তাতে কালাপানির অন্তর্ভুক্তি অলিকে নতুন সুযোগ তৈরি করে দেয়। ২০১৫ সালের ভারতের অবরোধ মানুষের স্মৃতিকে আবার চাঙ্গা করেছে। তবে এটাই শেষ কথা নয়। মানুষ সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। সুবিধামতো সময়ে হিসাবটা কড়ায়–গণ্ডায় বুঝে নেন। তাই চীনা ফ্যাক্টর সবসময়ের জন্য গ্যারান্টি নয়। তবে এটা খুব পরিষ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীনের উপস্থিতি ক্রমশ প্রকাশ্য।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণে এবং অভ্যন্তরণ গণতন্ত্রায়ণে বিশেষ করে বিরোধী দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বোঝাপাড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চীন কতোটা বিচক্ষণ হয়, তার ওপরে তার গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নও যুক্ত হয়ে পড়েছে। কূটনীতি বা রাজনীতি কোনোটিই একরৈখিক হয় না।
প্রকাশ : মানবজমিন, ২৭ জুন ২০২০, শনিবার, ৯:৫২