উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিদেশ যাওয়ার জন্য গত বছরের শুরু থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যশোরের ঝিকরগাছার শাহীন আলম। এজন্য আইইএলটিএস পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় স্কোর অর্জন করে ইউরোপের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন তিনি।
এর মধ্যে জার্মানির লিবনিজ ইউনিভার্সিটি হ্যানোভার থেকে ভর্তির আমন্ত্রণও পান এ ঢাবি গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু কভিড ১৯ এর কারণে আট মাস চেষ্টা করেও জার্মানির ভিসা পাননি তিনি। অন্যদিকে বৈধ ভিসা ছাড়া ভর্তি নিশ্চিত করতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত জার্মান দূতাবাস থেকে তেমন কোনো সাড়া পাননি শাহীন আলম।
তিনি বলেন, কয়েক মাস চেষ্টার পর মে মাসে ভিসা আবেদনের জন্য জার্মান দূতাবাসে একটি স্লট পাই। কিন্তু কভিড ১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে সে স্লটটিও বাতিল করে দেয়া হয়। এরপর স্লটটি রিশিডিউল করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
বিভিন্ন মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও দূতাবাস থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে অফার লেটারের মেয়াদ মার্চ থেকে বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করতে পেরেছি। এখন সেপ্টেম্বরের মধ্যেও ভিসা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। এখন আমার উচ্চশিক্ষায় বিদেশ যাওয়ার বিষয়টিই পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মধ্যে।
শাহীন আলমের মতো অন্তত অর্ধলক্ষ বাংলাদেশী শিক্ষক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে কভিড ১৯ এর প্রাদুর্ভাব। গন্তব্য দেশগুলোর দূতাবাসগুলোয় এখন মহামারীর কারণে ভিসা আবেদন প্রসেসিংয়ের বিষয়টি এক প্রকার বন্ধই বলা চলে।
অনিশ্চয়তা রয়েছে উড়োজাহাজের ফ্লাইট চলাচল নিয়েও। এসব জটিলতায় সময় পেরিয়ে যাওয়ায় ভর্তি বাতিল ও শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সব মিলিয়ে আশঙ্কাজর্জরিত এক অনিশ্চিত অপেক্ষায় দিন কাটছে এসব শিক্ষক শিক্ষার্থীর।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের অনেকেই প্রতি বছর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে যান। তাদেরও অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে মহামারীসৃষ্ট ভিসা জটিলতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সরকারের দেয়া কমনওয়েলথ স্কলারশিপের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তার বিলেতযাত্রাও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কভিড ১৯ এর কারণে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ওই শিক্ষক বলেন, প্রতি বছর জুন জুলাইয়ের মধ্যে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের সব বিষয় চূড়ান্ত হয়ে অক্টোবরে পিএইচডি সেশন শুরু হয়। যদিও এ বছর এখন পর্যন্ত স্কলারশিপের বিষয়টিই চূড়ান্ত হয়নি। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি।
জাতিসংঘের বিজ্ঞান শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল এডুকেশন শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৫০-৬০ হাজার শিক্ষক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিদেশ পাড়ি জমান। এক্ষেত্রে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকেই শিক্ষার্থীদের নজর থাকে সবচেয়ে বেশি।
এর বাইরে মালয়েশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও প্রতিবেশী ভারতেও বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী যান। কিন্তু বর্তমানে মহামারী পরিস্থিতিতে এসব গন্তব্যের কোনোটিতেই নতুন করে কোনো ভিসা অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। এমনকি এক দুই মাসের মধ্যেও পরিস্থিতি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আবার ছুটিতে দেশে এসে আটকে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়।
টিকিটের চড়া মূল্যের কারণে তাদের পক্ষেও এখন ফিরে যাওয়া বেশ মুশকিল হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমন নিয়ে বর্তমানে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা। ভিসা না পাওয়া বিদেশ গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীরা বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় ভিড় জমাচ্ছেন প্রতিদিনই।
উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমনেচ্ছু এসব শিক্ষক শিক্ষার্থী বর্তমানে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোয় ই-মেইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। তারা বলছেন, ভিসা নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা পেলে আশ্বস্ত হতে পারবেন তারা।
কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে দেশটিতে যেতে পারছেন না ড্যাফোডিল শিক্ষক শওকত আলী। চলতি মাসের শুরুতে তার ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও ভিসাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তায় সেমিস্টার মুলতবি করে সেটি জানুয়ারিতে শুরু করতে হচ্ছে তাকে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ ছিল। আমি চাচ্ছি সেখানে গিয়ে শুরু করতে। কিন্তু ভিসার জন্য কোনো স্লট পাওয়া যাচ্ছে না। কবে পাওয়া যাবে তারও কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই। সে অনিশ্চয়তা থেকেই সেমিস্টার ডিফার করে জানুয়ারিতে নিয়ে গেছি।
প্রতি বছর ১০০ বাংলাদেশী শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি দিয়ে নিয়ে যায় হাঙ্গেরি সরকার। এ বছরও হাঙ্গেরির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নের জন্য ১০০ শিক্ষার্থীকে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন দিয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও হাঙ্গেরি সরকার।
দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এরই মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলেও ভিসাকেন্দ্রিক জটিলতায় বৃত্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদের হাঙ্গেরি গমন এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়েছে।
ভিসা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হাঙ্গেরিতে বৃত্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীরা গতকালই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, কভিড ১৯ এর কারণে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বন্ধ। এ কারণে মনোনীতরা ভারতে অবস্থিত হাঙ্গেরি কনস্যুলেটে ভিসা আবেদন করতে পারেননি।
হাঙ্গেরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েকটি প্রোগ্রামে অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রমের সুযোগ দিলেও বেশির ভাগ প্রোগ্রামেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ফেস টু ফেস কার্যক্রমকে। শিগগিরই শারীরিকভাবে উপস্থিত হতে না পারলে মনোনীত শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার দিক থেকে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে পারেন।
তাছাড়া অনলাইনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরাও আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেখানে মূল্যায়নেও শিক্ষার্থীদের জন্য টিকে থাকা কঠিন হবে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, হাঙ্গেরির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য ভারতে অবস্থিত হাঙ্গেরি কনস্যুলেটে ভিসা আবেদন শারীরিকভাবে দাখিল করার নির্দেশনা রয়েছে। কভিড ১৯ এর কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ভারতে অবস্থিত হাঙ্গেরি কনস্যুলেট তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা যদি অনলাইনে বা বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো এজেন্টের মাধ্যমে ভিসা আবেদন জমা দিতে পারতেন, তাহলে তাদের অনিশ্চয়তাও কমত। এছাড়া বাংলাদেশে অবস্থিত জার্মান দূতাবাস হাঙ্গেরির শর্ট স্টে ভিসা প্রসেস করলেও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য দীর্ঘমেয়াদি ভিসা প্রসেস করে না।
বর্তমান কভিড ১৯ ক্রান্তিকাল বিবেচনায় জার্মান দূতাবাস যদি শিক্ষার্থীদের ভিসা আবেদন গ্রহণ করত তাহলেও শিক্ষার্থীদের পক্ষে সহজে হাঙ্গেরির ভিসার জন্য আবেদন করা সম্ভব হতো।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, এ পরিস্থিতি শুধু শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নয়, অনেকেই আছেন যারা বিদেশ থেকে দেশে এসেছেন কিন্তু ফিরে যাওয়া নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকের গ্রিন কার্ড, ওয়ার্ক পারমিট, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আমরা আলোচনা করেছি। কমিটিকে জানানো হয়েaছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হচ্ছে। আবার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদেরও সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়টিতে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, অনেকের কাজ চলে যাচ্ছে। প্রতিটি দূতাবাসের কথা হলো এখন কভিডকালে ডিসটার্বেন্স সব জায়গায়ই হচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ হলো অগ্রাধিকার। সংসদীয় কমিটির পরবর্তী সভায় এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাওয়া হবে।
-বণিক বার্তা