চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সমর্থনমূলক মস্কো সফরের বুধবার ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে শক্তি প্রদর্শন করেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ টুইটারে প্রকাশ করেছেন। দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপোরিজ্জিয়াতে দিনের বেলাতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স ফুটেজটি যাচাই করেছে। এতে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপ থেকে আগুনের ধোঁয়া উড়ছে। আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ অন্তত একজনের মৃত্যু ও ২৫ জনের আহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে।
জেলেনস্কি লিখেছেন, এই মুহূর্তে আবাসিক ভবনে সাধারণ মানুষ ও শিশুদের জীবনের ওপর হামলা হচ্ছে। ইউক্রেনে বা বিশ্বের অন্যত্র দিনটি শুধু আরেকটি দিন হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। বিশ্বের আরও বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন। রুশ ত্রাসকে দ্রুত পরাজিত করতে ও জীবন রক্ষায় দৃঢ়তা প্রয়োজন।
দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি নদীর তীরবর্তী শহর রিজিশ্চিভে অন্তত চার ব্যক্তি নিহত ও বেশ কয়েকজন দুটি ছাত্রাবাসের ধ্বংসস্তূপে অনেকেই চাপা পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উদ্ধার কাজে শতাধিক কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, জীবিতদের অনুসন্ধানে অভিযান চরছে।
ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলে বিমান হামলার সতর্ক সংকেত বাজানো হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী দাবি করেছে, রাশিয়ার সেনাবাহিনী হামলায় ২১টি ইরানি শাহেদ আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করেছে। এগুলোর মধ্যে ১৬টি ভূপাতিত করা হয়েছে।
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে চীনের প্রেসিডেন্টের সফরকে ইঙ্গিত করে জেলেনস্কি টুইটারে লিখেছেন, মস্কোতে কেউ যখন ‘শান্তি’ শব্দটি শুনতে চায়, তখন এমন অপরাধমূলক আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
গতকাল বুধবার রণাঙ্গন পরিদর্শন করেছেন জেলেনস্কি। তার কার্যালয় প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনি সেনাদের পদক দিচ্ছেন। বলা হয়েছে, বাখমুতের কাছে এই ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় এই ছোট্ট শহর দখলে দীর্ঘদিন ধরে আক্রমণ চালিয়ে আসছে রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে রক্তাক্ত স্থলযুদ্ধে পরিণত হয়েছে রাশিয়ার এই দখল অভিযান।
গত বছর ইউক্রেনে আক্রমণ ও পশ্চিমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পুতিনের জন্য মস্কোতে শি জিনপিংকে স্বাগত জানানো ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফলতা। দুই নেতা একে অপরকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থনৈতিক সহেযাগিতার, পশ্চিমাদের নিন্দা করেছেন এবং দুই দেশের সম্পর্ককে সর্বোৎকৃষ্ট অবস্থায় বলে উল্লেখ করেছেন।
চীন সরকারের এক বিবৃতি অনুসারে, দুই নেতা এই সম্পর্ককে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ঊর্ধ্বে এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও মানবতার ভবিষ্যতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মস্কো ছাড়ার আগে পুতিনকে শি বলেন, ১০০ বছরে যা ঘটেনি সেই পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা একত্রিত, তখন এই পরিবর্তন আমরাই আনি।
‘আমি একমত,’ বলেন পুতিন, তখন শি বলেন, দয়া করে, নিজের দিকে খেয়াল রেখো বন্ধু।
কিন্তু প্রকাশ্যে দুই নেতার মন্তব্য ছিল অনেকটাই সুনির্দিষ্ট। পুরো সফরে ইউæক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উল্লেখ করার মতো কিছু বলেননি চীনা প্রেসিডেন্ট। শুধু বলেছেন, চীনের অবস্থান ‘নিরপেক্ষ’।
ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহারে মস্কোর ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন। শি’র এই সফরের সময় নিয়েও সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর এই সফর আয়োজনে। গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাখ্যানে মস্কোর পাশে দাঁড়িয়েছে বেইজিং।
শান্তি পরিকল্পনা
শি জিনপিংয়ের অধীনে চীন নিজেকে নিরপেক্ষ শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। গত মাসে ইউক্রেন নিয়ে একটি শান্তি পরিকল্পনা তুলে ধরেছে দেশটি। পশ্চিমারা এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলছে, এই পরিকল্পনা কেবল রাশিয়াকে নিজেদের সেনাবাহিনীকে পুনরায় সংগঠিত করার সুযোগ দেবে।
হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি, এই মুহূর্তে কোনও যুদ্ধবিরতি মূলত রাশিয়াকে নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও সুযোগ দেওয়া।
এই শান্তি পরিকল্পনার জন্য শি জিনপিংয়ের প্রশংসা করেছেন পুতিন এবং প্রত্যাখ্যানের জন্য কিয়েভ ও পশ্চিমাদের সমালোচনা করেছেন। ইউক্রেন সতর্কতার সঙ্গে চীনা প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বেইজিংকে আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেনের নিজস্ব শান্তি পরিকল্পনাটি বিবেচনার জন্য। শি’র সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলেন জেলেনস্কি।
ইউক্রেন বলছেন, রাশিয়া দখলকৃত ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে কোনও শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। মস্কো বলছে, আঞ্চলিক ভূখণ্ডগত বাস্তবতাকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে কিয়েভকে। এর মাধ্যমে রাশিয়া মূলত ইউক্রেনের দখলকৃত এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ডের কথা ইঙ্গিত করতে চেয়েছে।
২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ইউক্রেন রাশিয়ার কাছ থেকে কিছু ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু শীতে আবার নতুন আক্রমণ শুরু করে। এবার নতুন নিয়োগ পাওয়া সেনা, রিজার্ভ সেনা এবং কারা োগার থেকে নিয়োগ দেওয়া ভাড়াটে যোদ্ধাদের আক্রমণে পাঠায় রাশিয়া।
তবে দীর্ঘ দিন ধরে রক্তাক্ত লড়াইয়ের পর, উভয়পক্ষ ব্যাপক হতাহতের শিকার হওয়ার পরও রণক্ষেত্রের সম্মুখ রেখায় খুব পরিবর্তন আসেনি।
গত চার-পাঁচ মাসে রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য সফলতা হলো পূর্বাঞ্চলীয় বাখমুত শহরের আশেপাশের কিছু ভূখণ্ড দখল করা। কিন্তু কিয়েভ জানিয়েছে, তারা শহরটি থেকে সেনাদের পিছু হটতে নির্দেশ দেবে না। শহরটি ত্যাগের আগে যতটা রুশ সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চিত করতে চায় তারা।
এক গোয়েন্দা তথ্যে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, বাখমুতে মস্কোর আক্রমণ ঝিমিয়ে পড়তে পারে। বাখমুতের পশ্চিমাঞ্চলে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ সরবরাহ রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকির চাপ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে।
বাখমুতে ইউক্রেনীয় সেনারা ঘেরাওয়ে পড়ার ঝুঁকি এখনও রয়েছে। তবে শহরটি দখলে রুশ সেনারা যে মোমেন্টাম পেয়েছিল তা ধরে হারিয়ে ফেলার বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সূত্র: রয়টার্স