ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সপ্তাহজুড়ে বিমান হামলা চালিয়ে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। নারী ও শিশুসহ আহতের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ২৩ হাজার অতিক্রম করেছে। এর মধ্যেই গাজায় নতুন করে স্থল হামলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)। সীমান্তে জড়ো করা হচ্ছে একের পর এক ট্যাংক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর গাজার ১১ লাখ মানুষকে অঞ্চলটি ছাড়ার আলটিমেটাম দিয়েছে ইসরায়েল। আইডিএফের তরফে গতকাল এ আলটিমেটাম দেয়া হয়।
এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, বিধ্বংসী মানবিক পরিণতি ছাড়া লাখ লাখ মানুষের স্থানান্তর সম্ভব নয়। জাতিসংঘের এ প্রতিক্রিয়াকে ‘লজ্জাজনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ইসরায়েল। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওভ গ্যালান্ট বলেছেন, ‘সময় এখন যুদ্ধের।’ যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বেনয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘সামনে কঠিন সময় আসছে।’
ইসরায়েলি বাহিনীর আলটিমেটামের পর থেকে আতঙ্কে গাজা ছাড়তে শুরু করেছে হাজার হাজার মানুষ। এতে উপত্যকার রাস্তায় মানুষের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়।
বড় ধরনের অভিযান চালানোর আগে কূটনৈতিক সমর্থন নিশ্চিতের চেষ্টা করছে ইসরায়েল। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। জার্মানি বলেছে, তাদের দুটি সশস্ত্র যুদ্ধ ড্রোন ইসরায়েলি বাহিনী এরই মধ্যে ব্যবহার করেছে। গ্রিসের একটি যুদ্ধজাহাজও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মোতায়েনের খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে এটি অবস্থান নেয়ার কথা রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানাতে দেশটি সফরে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক। গতকাল দেশটিতে পৌঁছেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইন এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট রবার্টা মেটসোলা।
ইসরায়েলের বিমান বাহিনী জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছয়দিনে গাজার ৩৬ হাজারেরও বেশি স্থাপনায় ছয় হাজার বোমাবর্ষণ করেছে তারা। তবে গত কয়েকদিনে নির্বিচারে চালানো এসব হামলায় সাদা ফসফরাসের যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, শুধু গাজা নয়, এমনকি লেবাননে চালানো হামলায়ও এমন যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেছে আইডিএফ।
জাতিসংঘ বলছে, গাজার পরিস্থিতি শোচনীয়। কারণ সেখানে খাবার ও পানি দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উপত্যকার সন্তানসম্ভবা প্রায় ৫০ হাজার নারী। কেননা স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাস, হাসপাতাল—সব জায়গায়ই হামলা চালানো হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাদের ১১ স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় উপত্যকায় ১ হাজার ৫৩৭ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৭৬ নারী এবং ৫০০ শিশুও রয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছে ৬ হাজার ৬১২ জন। অন্যদিকে হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ৩০০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলি নেতাদের কথায় এটা স্পষ্ট, তারা গাজা উপত্যকাজুড়ে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে নির্মূল করে দিতে চায়। তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রকৃতপক্ষে তেল আবিবের জন্য এটি হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, ৭ অক্টোবরের হামলায় ইসরায়েল থেকে শতাধিক লোকজনকে তুলে নিয়ে যুদ্ধবন্দি করেছে হামাস। তাদের রাখা হয়েছে গাজায়। এই বন্দিদের মধ্যে ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোর নাগরিকরাও রয়েছে। এরই মধ্যে হামাস জানিয়েছে, গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে নিজেদের ১৩ নাগরিককে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। যুদ্ধবন্দি হিসেবে তাদের ধরে আনা হয়েছিল।
কিরগিজস্তান সফররত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, নজিরবিহীন নৃশংস হামলার শিকার হওয়ার পর আত্মরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে। তবে গাজায় ইসরায়েলি স্থল অভিযানে বেসামরিকদের মৃত্যু হলে তা হবে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বন্ধে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে নিজেদের রাষ্ট্র পাবে ফিলিস্তিনিরা।’
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, ‘এই যুদ্ধ ফিলিস্তিনের প্রতি অবিচারের ফলাফল।’ বেইজিং সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি এমন মন্তব্য করেন।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ইসরায়েল না থামলে যুদ্ধ কয়েকটি ফ্রন্টে ছড়িয়ে পড়বে। তার ভাষায়, ‘ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় কোনো কোনো কর্মকর্তা আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন নতুন ফ্রন্ট খোলার কোনো আশঙ্কা আছে কিনা? উত্তরে আমি বলেছি, ইহুদিবাদীরা তাদের যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে যেতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য প্রতিরোধ আন্দোলন এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েতে পারে।’ ইরাক থেকে লেবাননে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। সেখান থেকে তার সিরিয়া যাওয়ার কথা রয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে দেশে দেশে বিক্ষোভ: ফিলিস্তিনে নির্বিচারে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে গতকাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, জর্ডান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জুমার নামাজের পর রাজপথে নেমে আসেন মুসল্লিরা। ফ্রান্সে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ নিষিদ্ধ হলেও বৃহস্পতিবার দেশটির রাজধানী প্যারিস, লিল্লা, বোদো ও অন্যান্য শহরে জড়ো হয় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। তবে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমান বলেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যারা বিক্ষোভ করছে তাদের গ্রেফতার করা উচিত।’
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে জুমার নামাজের পর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিপুলসংখ্যক মানুষ। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে আয়োজিত বিক্ষোভে অংশ নেয় লক্ষাধিক মানুষ। ইরানের রাজধানী তেহরানে বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিছিলে অংশ নেয় বিপুলসংখ্যক মানুষ। ইসরায়েল নিপাত যাক বলে স্লোগান দেয় তারা। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে জুমার নামাজের পর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি জানাতে জড়ো হয় হাজারখানেক মুসল্লি। ফিলিস্তিন মুক্ত করো, ইহুদিবাদীরা নিপাত যাক— এমন স্লোগান দেয় তারা। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদও এতে অংশ নেন।